ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিমানকর্মীদের আফসোস

পানির দরে বিক্রি হচ্ছে দুটো এয়ারবাস-যাচ্ছে ধোলাইখাল

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৮ জুলাই ২০১৭

পানির দরে বিক্রি হচ্ছে দুটো এয়ারবাস-যাচ্ছে ধোলাইখাল

আজাদ সুলায়মান ॥ তিন শত কোটি টাকার ডিসি-১০ পানির দরে বিক্রির পর এবার নিলামে তোলা হচ্ছে দুটো এয়ারবাস। এগুলোও বিক্রি করা হবে সস্তায়। ডিসি-১০ গুলোর মতোই এয়ারবাসও যাচ্ছে ধোলাইখালে ভাঙ্গাড়ির দোকানে। শত শত কোটি টাকার উড়োজাহাজগুলোর করুণ পরিণতিতে বিমানের কর্মীরা শুধু আফসোস ছাড়া কিছুই করতে পারছে না। এয়ারবাস দুটো অতি পুরনো ও লক্কড় ঝক্কড় হওয়ার কারণেই ছেড়ে দেয়ার সিদ্বান্ত নেয় বিমান। গত সেপ্টেম্বরে বহর থেকে দুটি এয়ারবাস এ-৩১০-৩০০ উড়োজাহাজ ফেজ আউট করে রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। কারণ হিসেবে বিমানের তরফ থেকে বলা হচ্ছে- পুরনো এ দুই উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটি প্রায় নিয়মিত ঘটনা হওয়ায় বহর থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল এসব উড়োজাহাজ। তাই এবার উড়োজাহাজ দুটি নিলামে বিক্রি করার জন্য ইতোমধ্যে দরপত্রও আহ্বান করা হয়। এক্ষেত্রে বিমান একেকটি এয়ারবাস খ-িত করে ধাপে ধাপে বিক্রির কৌশল নেয়। প্রথমেই এয়ারফ্রেম ও ল্যান্ডিং গিয়ার বিক্রি করতে যাচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষ। এ দুটি এয়ারবাস এ-৩১০-৩০০ উড়োজাহাজের এয়ারফ্রেম ও ল্যান্ডিং গিয়ার বিক্রি করতে ৭ জুলাই আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। দরপত্রে এয়ারফ্রেম ও ল্যান্ডিং গিয়ার ‘যেখানে, যে অবস্থায় আছে’ ভিত্তিতে বিক্রির কথা বলেছে বিমান। বিমানের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক সম্ভার) মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত ওই দরপত্রে বলা হয়েছে, এয়ারবাস এ-৩১০-৩০০ উড়োজাহাজ দুটির (নিবন্ধন নং যথাক্রমে এস২-এডিএফ//এমএসএস-৭০০ এবং এস২-এডিকে//এমএসএন-৫৯৪) দুটি এয়ারফ্রেম ও দুই লটে মোট ছয়টি ল্যান্ডিং গিয়ার বিক্রি করা হবে। এর মধ্যে তিনটি ল্যান্ডিং গিয়ার সচল রয়েছে। উড়োজাহাজ দুটি ক্রয়ে আগ্রহীদের আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে দরপত্র জমা দিতে হবে। উল্লেখ্য এর আগে পুরো উড়োজাহাজ বিক্রির জন্যও দরপত্র ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কেউ রেসপন্স করেনি। এ কারণেই এখন এয়ারবাসটি খ-িত করে একেকটি অংশ আলাদা আলাদা বিক্রির দরপত্র ডাকা হয়। এ বিষয়ে বিমানের পরিচালক প্রশাসন মমিনুল ইসলাম বলেন, ডিসি-১০ যেভাবে বিক্রি করা হয়েছিল এদুটো এয়ারবাসও একই কায়দায় বিমান থেকে ফেইজ আউট করার সিদ্বান্ত হয়েছে। এতে প্রথমেই বিক্রি করা হবে এয়ারবাস দুটোর খোলনলচে ও স্পেয়ার পার্টস। দ্বিতীয় ধাপে বিক্রি করা হবে ইঞ্জিন। এজন্য ডাকা হবে আলাদা দরপত্র। আসলে এ উড়োজাহাজ দুটির উড্ডয়ন মেয়াদ গত বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর নাগাদ শেষ হয়। সে সময় এগুলো উড্ডয়ন উপযোগী রাখতে হলে ডি-চেক (বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ) করাতে হতো। এতে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় হতো। তাই ডি-চেকের আগেই ব্যয়বহুল এ উড়োজাহাজ দুটি বহর থেকে বাদ দিয়েছিল বিমান কর্তৃপক্ষ। বিমানের সাবেক পরিচালক ড. সাফিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বহরে এয়ারবাস-৩১০ উড়োজাহাজ যুক্ত হয় ১৯৯০ সালে। সে সময় সম্পূর্ণ নতুন অবস্থায় দুটি এয়ারবাস-৩১০ কেনা হয়। এর মধ্যে একটি উড়োজাহাজ দুবাইয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে অচল হয়ে যায়। পরে আরও একটি এয়ারবাস-৩১০ উড়োজাহাজ পাঁচ বছরের চুক্তিতে লিজ নেয়া হয়, পরবর্তীতে যা কিনে নেয় বিমান। এ উড়োজাহাজটি উড্ডয়ন অনুপযোগী হয়ে প্রায় দুই মাস সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে পড়ে ছিল। এছাড়া ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অপর একটি এয়ারবাস-৩১০ উড়োজাহাজের বডিতে ফাটল ধরে। ওই সময় উড়োজাহাজটিতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বিভিন্ন সময়ে ব্যয়বহুল এসব উড়োজাহাজ বাদ দেয়ার কথা উঠলে প্রথমে ডিসি-১০ এবং পরবর্তীতে বাদ দেয়া হয় এয়ারবাস-৩১০। জানা যায়, এয়ারবাস দুটোর ক্রয়মূল্য ছিল আড়াই শ’ কোটি টাকা। যা এখন এক কোটি টাকায় বিক্রি করা দায়। কেননা এর আগে ৩শ’ কোটি টাকার ডিসি-১০ বিক্রি করতে হয়েছে সোয়া দুই কোটি টাকা। প্রথমে বিক্রি করা হয় ইঞ্জিন, যার প্রতিটি ৭৫ হাজার ডলার দর মিলেছে। একটি ডিসি-১০এ তিনটে ইঞ্জিন থাকে। সে হিসেবে শুধু একটি ডিসি-১০ এর ইঞ্জিন বিক্রি করা হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ওটার বাদ বাকি অংশ যেমন বডি, সিট ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ সমুদয় একত্রে বিক্রি করা হয়েছে ৪২ লাখ টাকা দরে। তার মানে একটি ডিসি-১০ নিলামে বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ২ কোটি ২২ লাখ টাকা। বিমানকর্মীদের আফসোসটা এখানেই তিন শত কোটি টাকার একটি ডিসি-১০ বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র সোয়া ২ কোটি টাকায়। একই করুণ পরিণতি ঘটতে যাচ্ছে এয়ারবাস দুটোর। এ দুটোর দাম যে ডিসি-১০-এর চেয়ে বেশি মিলবে তেমনটি বেশ জোর দিয়েই বলছে বিমান। জানা যায়, প্রথমে এয়ারবাস দুটো এয়ারফ্রেম ও ল্যান্ডিং গিয়ার বিক্রি করা হবে পরে হবে ইঞ্জিন। প্রশ্ন হচ্ছে এগুলো এত সস্তায় কিনে কি কাজে লাগানো যায়? এ সম্পর্কে ড. সাফিকুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, এর আগে রাফি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ডিসি-১০ দুটো নিলামে কিনে নেয়। শুনেছি তারা নাকি নিজেদেরই কারখানাতেই উড়োজাহাজের বডি ও অন্যান্য অংশ যেমন এলুমিনিয়াম ও কপার গলিয়ে কেজি দরে বিক্রি করেছে। এ ছাড়া অন্য কোন কাজে লাগানোর সুযোগ ছিল না। জানা যায়, বিমান বহরে মোট ৫টি ডিসি-১০ ছিল। এর মধ্যে একটি চট্টগ্রামে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সেটা ধোলাইখালে ভাঙ্গাড়ির দোকানে বিক্রি করতে হয়। এরপর দু’ধাপে অপর বাকি ৪টি ডিসি-১০ খোলা নিলামে তোলা হয়। এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট এভিয়েশান বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় জানান, বিমান চাইলে এসব উড়োজাহাজ আরও বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগাতে পারত। যেমন পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের উড়োজাহাজ উন্মুক্ত জায়গায় রেখে বাণিজ্যিক প্রদর্শনী করা হয়। কেউ শখ করে কিনে নিয়ে বাসা বাড়ি, বিশ্রামাগার ও হোটেল রেস্তরাঁ করে। যা কৌতূহলী মানুষের কাছে বেশ কদর পায়। বিমান এ বিষয়ে একটু কৌশলী হলে আরও চড়া দামে এগুলো বিক্রি করতে পারত। এই যেমন একটা ডিসি-১০ যদি পূর্বাচলের ৩শ’ ফুট রাস্তার পাশে রেখে রেস্টুরেন্ট করা যেতো তাহলে অবশ্যই সেটা বাণিজ্যিকভাবে সফল হতো। বিমানের রাজস্বও বাড়ত ঐতিহ্যও রক্ষা করা সম্ভব হতো। এ বিষয়ে ড. সাফিকুর রহমান ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, এমন সম্ভাবনা মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এত বিশাল একটা ডিসি-১০ শাহজালাল এয়ারপোর্ট থেকে আস্ত বের করার কোন উপায় নেই। না কেটে বের করার উপায় নেই। যারা কিনেছে তারা এভাবেই বের করে নিয়েছে। তবে যদি বিমানবন্দরের রাস্তা অন্যান্য দেশের মতো অনেক চওড়া হতো তাহলে হয়তো ক্রেন দিয়ে তুলে নিয়ে অন্যত্র প্রতিস্থাপন করা যেত।
×