ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রিসভায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের খসড়া অনুমোদন

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৮ জুলাই ২০১৭

মন্ত্রিসভায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের খসড়া অনুমোদন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন হাসপাতাল মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করতে পারবে না। একইসঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে নিকটাত্মীয়ের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। আইন অমান্য করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদ- ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে ‘মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৭’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সচিবালয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত আশরাফ শামীম সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সংশোধিত আইনে কিছু সংজ্ঞা পরিমার্জিত ও পুনর্গঠিত হয়েছে এবং আইনে কিছু বিষয় সংযোজিতও হয়েছে। সংশোধিত আইনের উদ্দেশ্য তুলে ধরে অতিরিক্ত সচিব বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবৈধ পাচারের সংযুক্তি ঘটেছিল, এটা (সংশোধিত আইন) সেটাও রোধ করবে। এ বিষয়টা (অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ) নিয়ে ব্যবসাপাতি করা সেটারও একটা প্রতিরোধক ভূমিকা এ আইন পালন করবে। কোন হাসপাতাল সরকারের অনুমতি ছাড়া মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করতে পারবে না। তবে সরকারী হাসপাতালে যেখানে বিশেষায়িত ইউনিট আছে সেখানে এ ধরনের অনুমতির প্রয়োজন নেই। যাদের অনুমতি নেই তারা এ আইন কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে অনুমতির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করবে। অঙ্গ সংযোজনে নিকটাত্মীয়ের পরিধি নিকট আত্মীয়ের মধ্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান ও সংযোজন করতে হবে। আইনে নিকট আত্মীয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী ও রক্তের সম্পর্কের আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন। আগের আইনে নিকট আত্মীয় বলতে পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাইবোন, ও রক্তের সম্পর্কের আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা ও স্বামী-স্ত্রী। নতুন আইনে নিকট আত্মীয়ের সংজ্ঞা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তবে চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজনের ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয় হওয়ার আবশ্যকতা নেই। আইন অনুযায়ী যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সংযোজন করা যাবে সেগুলো হলোÑ মানবদেহের কিডনি, হৃদপি-, ফুসফুস, অন্ত্র, যকৃত, অগ্নাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চোখ, চর্ম ও টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোন অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ। খসড়া আইনে ক্যাডাভেরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। ক্যাডাভেরিক অর্থ হৃদপি- স্পন্দনরত এরূপ মানবদেহ যা অনুমোদিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্রেন ডেথ ঘোষিত এবং যার অঙ্গ অন্য মানবদেহে প্রতিস্থাপনের জন্য লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কার্যক্ষম রাখা হয়েছে। ব্রেন ডেথ ঘোষণার পর কোন আইনানুগ উত্তরাধিকারী কোন ব্যক্তির দেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেয়ার জন্য লিখিতভাবে অনুমতি দেয় তবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেয়া যাবে। ব্রেন ডেথ ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোন দাবিদার না থাকলে ব্রেন ডেথ ঘোষণাকারী হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তৃত্বপালনকারী ব্যক্তি অনুমতি দিতে পারবে। ব্রেন ডেথ ঘোষণার জন্য একটি কমিটি থাকবে। এ কমিটি কোন ব্যক্তিতে ব্রেন ডেথ হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। ব্রেন ডেথ ঘোষণাকারী কমিটির কোন চিকিৎসক বা তার কোন নিকটাত্মীয় এরূপ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বা সংযোজনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। আইন অমান্যের শাস্তি কোন ব্যক্তি নিকট আত্মীয়তা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিলে বা ওই ধরনের তথ্য দিতে উৎসাহিত, প্ররোচিত বা ভীতি প্রদর্শন করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ জন্য তিনি কমপক্ষে ২ বছরের কারাদ-ে দ-িত বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-নীয় হবে। নিকট আত্মীয় সংক্রান্ত অপরাধ ছাড়া এ আইনের অন্য কোন বিধান লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ে দ-িত হবে। এ আইনের অধীনে কোন অপরাধের জন্য কোন চিকিৎসক দ-িত হলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের মাধ্যমে তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল যোগ্য হবে। কোন হাসপাতাল এ আইনের অধীনে কোন অপরাধ করলে এ হাসপাতালের পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত মালিক বা পরিচালক, তিনি যে নামেই পরিচিত হোন না কেন তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। যদি না তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে ওই অপরাধ তার অজ্ঞাতসারে হয়েছে এবং তা রোধ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কোন হাসপাতাল এ আইনের অধীনে কোন অপরাধ করলে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের অনুমতি বাতিল হবে এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য অর্থদ- আরোপ করা যাবে। আগে আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে তিনি সর্বোচ্চ ৭ বছর ও কমপক্ষে ৩ বছরের কারাদ-ে বা কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ের বিধান ছিল। সংশোধিত আইনে শাস্তি কমল কিনাÑ এ বিষয়ে আশরাফ শামীম বলেন, আগে শাস্তি ছিল ঢালাওভাবে, অনির্ধারিত। এবার দ-ের ক্ষেত্রগুলো সুনির্ধারিত করা হয়েছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দাতা ও গ্রহীতার যোগ্যতা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দাতা হিসেবে কোন ব্যক্তি উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন না যদি ব্রেন ডেথ (মৃত) ঘোষিত ব্যক্তির ক্যাডাভেরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বয়স ২ বছরের কম বা ৬৫ বছরের বেশি হয়। এখানে হয়তো কার্যকারিতার প্রশ্ন আছে। আগের আইনে এটা ছিল না। তবে চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজনের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। ২ থেকে ৬৫ বছর খাটবে না। জীবিত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের ক্ষেত্রে বয়স ১৮ বছরের কম বা ৬৫ বছরের বেশি হবে না। তবে ওই ব্যক্তি মৃত্যুর আগে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের লিখিত আপত্তি করে থাকেন তবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেয়া যাবে না। দাতার সংশ্লিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা কোনক্রমে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং দাতার চোখ, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে এজিবিএসএজি, এনটিএইচসিবি এবং এইচআইভি পজেটিভ থাকলেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেয়া যাবে না। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহীতা হিসেবে কোন ব্যক্তি উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন না যদি তার বয়স ২ বছর থেকে ৭০ বছরের মধ্যে না হয়। তবে শর্ত থাকে যে ১৫ বছর থেকে ৫০ বছরেরর ব্যক্তিরা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহীতা হিসেবে অগ্রাধিকার লাভ করবেন। চোখের কর্ণিয়া প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে গ্রহীতার বয়সের এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে মেডিক্যাল বোর্ড অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করতে হবে। বোর্ডের প্রধান হবেনÑ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সার্জারিতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন চিকিৎসক। এছাড়া সদস্য হিসেবে থাকবেন কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন এ্যানেস্থেসিওলজিস্ট এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বা চিকিৎসক। মেডিক্যাল বোর্ড প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক বা একাধিক সদস্য অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। এ বোর্ড দাতা ও গ্রহীতার আত্মীয়তার সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন ও ব্রেন ডেথ (মৃত) ঘোষিত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত দেবে। মেডিক্যাল বোর্ডের ওপরে থাকবে প্রত্যায়ন বোর্ড অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও সংযোজনে সহায়তা দিতে প্রত্যায়ন বোর্ড গঠিত হবে। মেডিক্যাল বোর্ডের ওপর এর অবস্থান হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমপক্ষে উপ-পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা হবেন এ বোর্ডের প্রধান। এ কমিটিতে সদস্য চারজন। জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত আইনানুযায়ী ব্রেন ডেথ (মৃত) মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের জন্য সরকার ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটি গঠন করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেনÑ এ কমিটির সভাপতি। ১১ সদস্যের এ কমিটিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কমপক্ষে যুগ্ম সচিব পদদর্যাদার একজন কর্মকর্তা এ কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। জাতীয় কমিটি ক্যাডাভেরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ কার্যক্রমের বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবে। ক্যাডাভেরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ কার্যক্রম পরিদর্শন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ কার্যক্রম সহজীকরণ, সম্প্রসারণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য তাৎক্ষণিক পরামর্শ দেবে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ দেবে।
×