ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্যায়ন নেই সংগ্রাহক নুরুল ইসলামের

চার হাজার বছর আগের কয়েন, ধারাবাহিক ইতিহাসের স্মারক

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৭ জুলাই ২০১৭

চার হাজার বছর আগের কয়েন, ধারাবাহিক ইতিহাসের স্মারক

মোরসালিন মিজান ॥ কাঁদছিলেন নুরুল ইসলাম। ৮৮ বছর বয়সী একজন মানুষ। কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করতেই শিশুটির মতো কাঁদলেন। ভীষণ অভিমান থেকে এই কান্না। এর অবহেলা। তার মিথ্যা আশ্বাস। সবই যেন হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার। কান্না লুকোতে পারেন না। মাঝে মাঝেই চিৎকার করে ওঠেন। বলেন, ‘জীবনে আর কিছু তো করিনি। কয়েনের পেছনে ছুটেছি। সর্বস্ব ব্যয় করেছি কয়েন সংগ্রহের কাজে। আমার জন্য ? না। দেশের জন্য। দেশের স্কলাররা এসব মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করছেন। নতুন নতুন ইতিহাস আবিষ্কৃত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসবিদরা আমার সংগ্রহের কথা জেনে বিস্মিত। অথচ নিজের দেশ এবং সরকার বুঝল না। বোঝানো গেল না। অর্থের অভাবে ধুঁকছি আমি। আমার সংগ্রহশালাটি পুরোদমে চালু করতে পারছি না। এই দুঃখ কোথায় রাখি?’ কান্নাটা এ কারণেই। তবে বেদনায় নয় শুধু, আনন্দেও কাঁদেন নুরুল ইসলাম। ভেজা চোখে তিনি বলছিলেন, ‘এত দুর্লভ সংগ্রহ দেশে আর কারও কাছে নেই। পাবে না কেউ। চ্যালেঞ্জ। আমার কাছে আসতে হবে।’ হ্যাঁ, রবিবার যাওয়া হয় প্রবীণ সংগ্রাহকের কাছে। আগারগাঁয়ে থাকেন। দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নড়বড়ে একটা শরীর নিয়ে অপেক্ষা করছেন তিনি। বয়সের ভারে কিছুটা ক্লান্ত। তবে কয়েনের কথা শুরু হতে না হতেই উদ্যম ফিরে পেলেন! বললেন, ‘কিশোর বয়সেই সংগ্রহ শুরু করে দিয়েছিলাম। আমার মা হাত ভর্তি করে কাঁচের চুরি পড়তেন। সামান্য ঠুকাঠুকি হলে সেগুলো ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেত। রঙিন চুরির ভগ্নাংশ কৌটায় পুরে রাখতাম। ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ার সময় স্ট্যাম্প সংগ্রহ করেছি। ১৯৪২ সালের দিকে, যখন ব্রিটিশদের শাসন চলছে, পিতার চাকরি সূত্রে আমরা ছিলাম পশ্চিমবঙ্গের হাওরায়। সেখানে অবস্থান কালেই আমি কয়েন সংগ্রহের দিকে ঝুঁকি। মা এবং নানির কাছে মোগল আমলের পুরনো অনেক কয়েন ছিল। তাদের কাছ থেকে সংগ্রহের শুরু। নানির বাবা আমীর রাহা ছিলেন দিল্লীর দরবারের মুন্সী। তার কাছ থেকে ব্রিটিশ কয়েন পেয়েছি। দেশ ভাগের পর ঢাকায় চলে আসি আমরা। ঢাকার জিন্নাহ এভিনিউতে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) পুরনো কয়েনের একটি দোকান ছিল। গুলশানেও ছিল একটি। আমি দোকানগুলো ঘুরে কয়েন সংগ্রহ করতাম। এখনও দেশ বিদেশের বিভিন্ন সূত্র কাজে লাগিয়ে কয়েন সংগ্রহ করি। এভাবে রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে কয়েন।’ বর্তমানে সংগ্রহ এতো বিপুল বিশাল যে, নিজেও গুনে শেষ করতে পারেন না। আনুমানিক হিসাব বললে, সংখ্যাটি হয় পাঁচ হাজার। পৃথিবীর কত প্রান্ত থেকে যে মুদ্রা এসেছে! তবে এই উপমহাদেশের মুদ্রাগুলোর কথা আলাদা করে বলতে হয়। ভারতবর্ষের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরতে যত মুদ্রার প্রয়োজন সবই তার আছে! বিভিন্ন কালে যুগে যত শাসক এসেছেন তাদের সকলের মুদ্রা তিনি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু তার দেখালেন নুরুল ইসলাম। শত সহস্র বছরের পুরনো মুদ্রা দেখে বিস্ময় কাটে না! পুরো সংগ্রহটা অবশ্য আলোকচিত্রের সাহায্য নিয়ে দেখতে হয়। আপাতত ছবি দিয়ে সংগ্রহশালাটি সাজিয়েছেন তিনি। নব নির্মিত ভবনের তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, টাইলসের ওপর রাজা বাদশা প্রশাসকদের প্রতিকৃতি। নিচে তাদের প্রবর্তন করা অথবা ব্যবহার করা মুদ্রা। উপমহাদেশের মুদ্রা ইতিহাসের বইয়ে পড়া আলোচিত চরিত্রগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। প্রদর্শনী কক্ষের একটি ভাগে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রাচীন যুগের দুর্লভ মুদ্রা। প্রথমেই চোখে পড়ে ক্ষুদ্রাকৃতির ছাপাঙ্কিত মুদ্রা। এগুলো চার হাজার বছরের পুরনো! একই দেয়ালে শিশুনাগ, বিম্বিসার, অজাতশত্রু, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, পৌষ্য মিত্র শুঙ্গ, বাসুদেব কুম্ভসহ প্রাচীন যুগের সকল রাজার মুদ্রা প্রদর্শিত হচ্ছে। মহাপদ্ম নন্দের মুদ্রা আর কারও কাছে আছে বলে জানা যায় না। নুরুল ইসলামের সংগ্রহে রয়েছে একাধিক। গুপ্ত যুগের শ্রী গুপ্ত থেকে আরম্ভ করে সমুদ্র গুপ্তসহ মোট পাঁচজনের কয়েন রয়েছে এখানে। এর পর আসেন ইতিহাসের আরেক আলোচিত চরিত্র সমতটের রাজা শশাঙ্ক। তার একটি স্বর্ণমুদ্রা দেখিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, অনেকে জানেন না যে, বঙ্গাব্দ গণনা এই রাজার সময়ে শুরু হয়েছিল। রাজভট্ট, বলভট্ট, খরগ রাজাসহ সমতটের অন্য সব রাজাদের মুদ্রা প্রদর্শিত হচ্ছে সংগ্রহশালায়। সংগ্রহশালার আরেকটি ভাগে রাখা হয়েছে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের মুদ্রার ছবি। মধ্যযুগের শুরু করা হয়েছে সুলতানদের ছবি দিয়ে। মোহাম্মদ বিন কাশেমের শাসনামলে প্রবর্তিত মুদ্রা প্রথমে চোখে পড়ে। এই যুগের খুব দুর্লভ সংগ্রহ সুলতানা রাজিয়ার রৌপ্য মুদ্রা। শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদীর মুদ্রাও বাদ যায়নি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আসে মোগলদের শাসন ও তাদের মুদ্রা। প্রথমেই সম্রাট বাবরের ছবি। নিচে তার ব্যবহৃত রৌপ্য মুদ্রা। পাশেই হুমায়ুন ও জাহাঙ্গীরের মুদ্রা রাখা হয়েছে। দুটোই এখন দুর্লভ। বিশেষ করে বলতে হয় কামরানের ছবি এবং মুদ্রার কথা। এই ছবি এবং মুদ্রা আর কারও কাছে আছে কি না, বলা মুস্কিল। বাহাদুর শাহ জাফরের সময় শেষ হয় মোগল শাসন। সংগ্রহে আছে তার মুদ্রাও। আধুনিক যুগে এসে পাওয়া যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। এই সময়ের সব মুদ্রা সংগ্রহ করেছেন নুরুল ইসলাম। তার সংগ্রহে রয়েছে উইলিয়াম ফোরের প্রতিকৃতি সম্বলিত মুদ্রা। মুদ্রাটির গায়ে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ লেখা থাকতে দেখা যায়। একই সময় কুইন ভিক্টোরিয়ার নামে চালু করা কয়েনের ছবি রাখা হয়েছে প্রদর্শনী কক্ষে। এর পর দেখানো হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের কয়েন। ১৮৭৭ সালের একটি কয়েনে লেখা রয়েছে ‘ভিক্টোরিয়া এমপ্রেস’। পরের কয়েনগুলো সপ্তম এ্যাডওয়ার্ড, পঞ্চম জর্জ, অষ্টম এ্যাডওয়ার্ড এবং ষষ্ঠ জর্জের শাসনামলের। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ বিদায়ের পর জন্ম নেয় স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান। দুই দেশেরই দুর্লভ কয়েন ও নোট প্রতর্শিত হচ্ছে প্রদর্শনী কক্ষের একটি ওয়াল শোকেসে। পাকিস্তানের নোট ও কয়েনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতিকৃতি দৃশ্যমান হয়। আছে বাংলাদেশের সব কয়েন ও নোট। ১৯৭২ সালে বের করা হয় প্রথম নোটটি। ১ টাকার সে নোট নিজে ব্যাংকে গিয়ে ওই দিনই সংগ্রহ করেন নুরুল ইসলাম। পাশাপাশি বাংলাদেশ জন্মের পর যত কয়েন ও নোট প্রবর্তিত হয়েছে সবই তিনি সংগ্রহ করেছেন। ওয়াল শোকেসে সেগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে। এসবের বাইরে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুদ্রা। হযরত মুহম্মদ (স)-এর জন্মের আগে আরবে প্রচলিত মুদ্রা সংগ্রহ করেছেন নুরুল ইসলাম। আছে আরও বেশ কয়েকটি অঞ্চলের দুর্লভ সংগ্রহ। হ্যাঁ, সংগ্রহ অনেকেই করেন। তবে নুরুল ইসলামের বেলায় লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, তিনি উচ্চ শিক্ষিত সচেতন সংগ্রাহক। ১৯৫২ সালে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হন। অসততার আশ্রয় নিতে পারবেন না বলে চাকরি করা হয়নি। ১০ থেকে ১২টি চাকরি কিছুদিন করে ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের লেখাপড়া ও ইতিহাসের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি সংগ্রহ করেছেন মুদ্রা। এর ফলেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশের মুদ্রাগুলো উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি তিনি দেশ বিদেশের বিখ্যাত সংগ্রাহক ও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। মুদ্রা নিয়ে নিজের বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে উপস্থাপন করেন। সব মিলিয়ে অনন্য এক প্রতিষ্ঠানের নাম নুরুল ইসলাম। গর্ব করে তিনি বলেন, শত সহস্র বছরের পুরনো কয়েন বলা চলে বুকে আগলে রেখেছি আমি। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা জাদুঘরটিও ধারাবাহিকভাবে সাজাতে পারেনি। আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগ সফল হয়েছে। তিনি জানান, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সংগ্রহশালাটি আপাতত আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। তবে গবেষকরা চাইলে যে কোন মুদ্রা তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। দেশ বিদেশের বহু নাম করা ইতিহাসবিদ তার মুদ্রা নিয়ে রিসার্চ করেছেন। পিএইচডি করেছেন। গবেষণার কাজকে গুরুত্ব দিয়েই ভবিষ্যত পরিকল্পনা সাজাতে চান বলে জানান তিনি। একই উদ্দেশে কিছু দুর্লভ মুদ্রা দান করেছেন জাতীয় জাদুঘর ও টাকা জাদুঘরে। কিছু মুদ্রা বিক্রিও করতে হয়েছে। সংগ্রহশালা নির্মাণের খরচ যোগাতেই কয়েন বিক্রি করেন তিনি। সে কথা জানিয়ে বলেন, আমার দীর্ঘ পথ পরিক্রমার কোন পর্যায়েই সরকারের কোন সহযোগিতা পাইনি। সরকারের লোকেরা নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাকে ঘুরিয়েছেন। আমি প্রবীণ মানুষ। ঘুরে বেড়িয়েছি। সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর কাছে ডেকে বাহবা দিয়েছেন। দেখা করলে ভাল ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সামান্য অর্থ সহায়তা আমার পাওয়া হয়নি। শেষ কথাটি আমাদের কেমন যেন অপরাধী করে দেয়। নুরুল ইসলাম বলেন, এমন অবহেলা আমার প্রাপ্য ছিল না!
×