ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইনে এমপিওভুক্তি-মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি আরও বেড়েছে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ জুলাই ২০১৭

অনলাইনে এমপিওভুক্তি-মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি আরও বেড়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এমপিও পেতে সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষকদের দিতে হচ্ছে ঘাটে ঘাটে ঘুষ- এমন নানা সঙ্কটের চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এবার নড়েচড়ে বসেছে শিক্ষা প্রশাসন। খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাই স্বীকার করলেন, অনলাইন ও বিকেন্দ্রীকরণের পর এমপিওভুক্তিতে মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি আরও বেড়েছে। ঘুষের বিনিময়ে এমপিওভুক্তি ও এ সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতির শত শত অভিযোগ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) জমা হচ্ছে বলে কর্মকর্তারাই অভিযোগ করেছেন। অবস্থা শুনে শিক্ষামন্ত্রী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, তাহলে পত্রিকায় প্রকাশিত এমপিও দুর্নীতির প্রতিবেদন শতভাগই সত্য! রবিবার মাউশিতে আয়োজিত দিকনির্দেশনামূলক এক সভায় উপস্থিত হন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইন। এ সময় মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে তার কাছেই অনলাইনে এমপিওভুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এ সমস্যার সমাধান চাইলেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা। মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামানের সভাপতিত্বে সভায় সংস্থার সব পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক ও অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মহাপরিচালক অধ্যাপক এসএম ওয়াহিদুজ্জামান মন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘স্যার, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা একবার অস্পষ্ট দেখে এমপিওর আবেদন রিজেক্ট করেন। আরেকবার অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখে রিজেক্ট করেন। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের হাতেই নিয়োগ, আবার তারাই এমপিওভুক্ত করেন। এ কারণেই দুর্নীতি বেশি হয়। শিক্ষকদের ভোগান্তি বেড়েছে।’ সভায় প্রশ্নোত্তরপর্বে শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মনিটরিং) অধ্যাপক ড. সেলিম মিয়া অভিযোগ করেন, অনলাইনে এমপিওভুক্তিতে মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। উপজেলা, জেলা ও উপ-পরিচালকের দফতরে দুর্নীতি হচ্ছে। এমনকি আমি সুপারিশ করার পরও আমার এক আত্মীয়র কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে শিক্ষা অফিস। এ সময় আরও দুই কর্মকর্তা একই অভিযোগ করেন। ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান, ‘আপনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন তা আমাকে জানান। নাম দিন, আমি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব। এমপিও প্রদানে আগের ম্যানুয়াল পদ্ধতি পুনরায় চালুর ঘোষণা দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অনলাইনে এত বেশি দুর্নীতি তা আগে কেন বলেননি? আরও আগেই অনলাইন পদ্ধতি বাদ দিয়ে দিতাম। এমপিও দুর্নীতির বিষয়ে মাউশি মহাপরিচালক বা মন্ত্রীকে সরাসরি জানানোর জন্যও ভুক্তভোগীদের প্রতি আহ্বান জানান নুরুল ইসলাম নাহিদ। এরপর শিক্ষা অধিফতরের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আপনারা সৃজনশীল কাজ করুন, এক্ষেত্রে কোন ভুল বা ক্ষতি হলেও এর দায় আমি নেব। মাউশির কর্মকা-ে অনেক সাফল্য রয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে হবে। এ সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। মাউশিতে মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ অনেক বেশি। যারা কাজের জন্য আসেন, তাদের সন্তুষ্ট করে দিতে হবে। মানুষের কাছে ভাল ইমেজ তৈরি করতে হবে। মাউশির কাজের মান আরও উন্নত করার জন্য মন্ত্রী বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে বলেন, মাউশির কর্মকা- আরও গতিশীল করতে হবে। কাজে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সততা ও নিষ্ঠা প্রমাণ করা, কর্মকর্তাদের দক্ষতা আরও বাড়ানো এবং এ দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। মনিটরিং কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। কর্মকর্তাদের সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। সমস্যা ও ব্যর্থতাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। মন্ত্রী প্রকল্প পরিচালকদের কাজ রিভিউ করে প্রকল্পগুলোতে যোগ্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। মন্ত্রী কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বিদেশ সফরের বিষয়ে বলেন, একই কর্মকর্তা ঘুরেফিরে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। তিনি সবাইকেই সুযোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন বলেন, সেবাগ্রহীতাদের আরও সহজে কিভাবে সেবা দেয়া যায় সে বিষয়টি ভাবতে হবে। আইটির যুগে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। কম সময়ে সেবা প্রদান করতে হবে। সরকারী কর্মচারীদের নিজেদের প্রভু না ভেবে জনগণের সেবক ভাবতে হবে। এর আগে জনকণ্ঠে ‘এমাপিও পেতে পাঁচ স্তরে ঘুষ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল শিক্ষা প্রশাসনে। ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তের নির্দেশ আসে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি)। ওই প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে মাউশি থেকে সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষকদের এমপিও আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের হাতে দেয়ার পর সেখানকার অনিয়ম ও দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র। আগে যেখানে এক শিক্ষককে মাউশিতে টাকা দিতে হতো, সেখানে এখন মাউশিতে কাজগপত্র পৌঁছাতে শিক্ষককে ঘুষ দিতে হচ্ছে অন্তত পাঁচ স্তরে। জানা গেছে, সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ মাউশি থেকে অঞ্চলে অঞ্চলে ভাগ করে সুফলের পরিবর্তে সঙ্কটই বাধিয়ে ফেলেছে শিক্ষা প্রশাসন। এমপিওর সঙ্গে যেন ঘুষ দুর্নীতিও বিকেন্দ্রীকরণ করে ফেলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি। এমপিওর কাজ হাতে পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাউশির সব আঞ্চলিক কার্যালয়। আগে এমপিওর জন্য কেবল মাউশিতে ঘুষ দেয়া লাগলেও পরিস্থিতি এখন আরও ভয়াবহ। নিয়োগের পর শিক্ষক-কর্মচারীকে ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে ফাইল পার করতে হচ্ছে। স্কুল-কলেজ থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা থেকে জেলা, জেলা থেকে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস থেকে মাউশিতে ফাইল আনতেও চলছে একই খেলা। এমপিও আঞ্চলিক কেন্দ্রের হাতে দেয়া এবং সেখানে তথ্য যাচাইয়ের কোন সুযোগ না থাকায় সঙ্কট এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে বলে বলছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে মাউশিতে। অভিযোগ আসছে মন্ত্রণালয়ে। এমপিওর ক্ষমতা মাউশির আঞ্চলিক কেন্দ্রের হাতে দেয়ার পর প্রায় দেড় বছর হতে চলেছে। এ সময়ে প্রতি মাসের এমপিও প্রদানেই গুরুতর সব দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে। গত বছর মাউশির হাতে থাকা এ এমপিও নয়টি আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল ঘুষ, দুর্নীতি রোধ করা। কিন্তু এক বছরে লক্ষ্য তো পূরণ হয়নি বরং শিক্ষকদের হয়রানি কয়েকগুণ বেড়েছে। বেপরায়া হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমপিও পেতে শিক্ষকপ্রতি ঘুষ লাগছে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর যদি কাগজপত্রে সামান্যতম কোন ঘাটতি থাকে তাহলে ঘুষের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের ঘুষের প্রমাণ দিয়ে প্রতিদিনই শিক্ষকরা অভিযোগ জমা দিচ্ছেন। আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের নয় উপ-পরিচালকের (অঞ্চলের প্রধান কর্মকর্তা) মধ্যে চারজনের বিরুদ্ধেই কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের অভিযোগ নিয়ে চলছে তদন্ত। দুর্নীতির মাধ্যমে এমপিও প্রদানসহ ‘সাংঘাতিক’ সব অপরাধের প্রমাণ পাওয়ায় আরও চার উপ-পরিচালকসহ ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে মাউশিকে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ এমপিও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের চার উপ-পরিচালক (ডিডি), চার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ছয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। তবে মন্ত্রণালয়ের আদেশ পেয়েও মাউশির একটি চক্র অপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গায়েব করে ফেলা হয়েছে ফাইল, যা জানেন না খোদ মহাপরিচালকও।
×