ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেই অর্চনার গ্রামের বাবা মা এবং ভাইদের কথা-

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ জুলাই ২০১৭

সেই অর্চনার গ্রামের বাবা মা এবং ভাইদের কথা-

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ফরহাদ মজহারের ভক্ত (সেবাদাসী) অর্চনা মিস্ত্রির এনজিওতে চাকরি মেনে নিতে পারেননি তার বৃদ্ধ বাবা শংকর চন্দ্র মিস্ত্রি (৬৮)। এজন্য অর্চনা বাড়িতে বেড়াতে এলে প্রায়ই তার সঙ্গে বৃদ্ধ বাবা শংকরের বাগ্বিত-া হতো। তবে অর্চনার বাবা মেয়ের চাকরির বিরোধিতা করলেও তার (অর্চনা) মা নীলিমা মিস্ত্রি মেয়েকে সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার দক্ষিণ সোনাখালী গ্রামের সুধন চন্দ্র মিস্ত্রির ছেলে কৃষক শংকর চন্দ্র মিস্ত্রির কন্যা অর্চনা মিস্ত্রির প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত মে মাসে শংকর মিস্ত্রি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওই সময় অর্চনা সর্বশেষ তার বাবাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে এসে ১০/১২দিন ছিল। ফরহাদ মজহারের অপহরণ নাটকের কয়েকদিন আগে অর্চনার ছোট ভাই সঞ্জয় মিস্ত্রি তার অসুস্থ বাবাকে চিকিৎসার জন্য বোন অর্চনা মিস্ত্রির ঢাকার বাসায় নিয়ে যায়। ৮/১০দিন আগে চিকিৎসা শেষে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছেন শংকর মিস্ত্রি। বর্তমানে শংকর মিস্ত্রি, তার দ্বিতীয় স্ত্রী নীলিমা মিস্ত্রি ও মেজ ছেলে দিনমজুর সুবির মিস্ত্রি গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। অনেক চেষ্টার পর রবিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে প্রতিবেশী এক যুবকের সহায়তায় এ প্রতিনিধির সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় অর্চনার বৃদ্ধ বাবা শংকর মিস্ত্রির। তিনি বলেন, অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনার পর বেশ কয়েক বছর অর্চনার লেখাপড়া বন্ধ ছিল। এরপর ৫/৬ বছর আগে একটি বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে অর্চনার রাগারাগি হলে আমাকে না জানিয়েই অর্চনা বাড়ি ছাড়ে। পরবর্তীতে একবছর পর বাড়িতে এসে অর্চনা জানায় সে একটি এনজিওতে চাকরি নিয়েছে। আমি তার এনজিওর চাকরিটি ভালভাবে মেনে নিতে পারিনি। বারবার অর্চনাকে এনজিওর চাকরি ছেড়ে বাড়িতে আসতে বলেছি। তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য একাধিকবার প্রস্তাব দিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। বয়স বেড়ে যাওয়াসহ রোগাক্রান্ত শরীর নিয়ে এখন আর আমি জোর করে কিছুই করতে পারি না। তাই ছেলেমেয়েও আমার কথা শোনে না। তারা যা ভাল মনে করে, তাই করে। সম্প্রতি ফরহাদ মজহার অপহরণ নাটক ও অর্চনাকে নিয়ে সৃষ্ট কৌতূহলের বিষয়ে অর্চনার বৃদ্ধ বাবা শংকর মিস্ত্রি বলেন, এ বিষয়ে আমি আর কি বলব! কে শোনে আমার কথা। ছেলেমেয়েরা মনে করে এখন তারা বড় হয়ে গেছে তাই আমার কথা কেউ শোনে না। তিনি আরও বলেন, জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও যে আমাকে এমন অপবাদের কথা শুনতে হবে তা কোনদিন ভাবতেও পারিনি, এ জন্যই অর্চনাকে এনজিওর চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। আমার কথা না শোনায় আজ এমন অপবাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে পুরো পরিবারকে। তিনি (শংকর মিস্ত্রি) তার মেয়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সর্বনাশকারী এনজিও মালিকের (ফরহাদ মজহার) দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফরহাদ মজহার অপহরণ নাটকের পর পরই অর্চনাকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর অর্চনার পরিবারের সদস্যরা লোকলজ্জা ও গ্রেফতার আতঙ্কে বসতঘর তালাবদ্ধ করে কয়েকদিন আত্মগোপন করেছিলেন। কয়েকদিআগে তারা বাড়িতে ফিরে এসেছেন। এরপর থেকেই প্রতিদিন গ্রামবাসী তাদের বাড়িতে এসে ভিড় করলেও তারা মুখ খুলছেন না। এমনকি তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্চনার গ্রামের একাধিক প্রতিবেশী বলেন, একজন সামান্য কৃষকের মেয়ে হয়েও বাবার সঙ্গে অভিমান করে অষ্টম শ্রেণী পাস অর্চনা মিস্ত্রি ঢাকায় গিয়ে এনজিওতে চাকরি নেয়ার পর থেকেই রাতারাতি তার (অর্চনা) চলাফেরা, আচার-আচরণ সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। সে যখন বাড়িতে আসত তখন তার চলাফেরা, কথাবার্তায় মনে হতো সে কোন এক কোটিপতির সান্নিধ্য পেয়েছে। অর্চনা দের প্রতিবেশী কয়েক গৃহবধূ বলেন, গ্রামে বেড়াতে এলে গল্প করে অর্চনা তাদের কাছে বলতÑবর্তমান সরকার পরিবর্তন হলে তার ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে তাদের গ্রামের চেহারাও পাল্টে যাবে। এসব কথা এলাকাবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি ভালভাবে মেনে নেয়নি গ্রামের লোকজন। তারা প্রায়ই অর্চনার চাকরির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার জন্য তার বাবাকে চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। সম্প্রতি ফরহাদ মজহার অপহরণ নাটকের পর অর্চনাকে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে অর্চনার অহংকারের গোমর ফাঁস হয়ে যায় দক্ষিণ সোনাখালী গ্রামবাসীর কাছে। সূত্রমতে, শংকর মিস্ত্রির প্রথম স্ত্রী বিপুল চন্দ্র ও সুবির চন্দ্র নামের দুই ছেলে রেখে মারা যান। এরপর পিরোজপুর জেলা সদরের বাসিন্দা নীলিমা রানীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করেন শংকর। ওই সংসারের বড় মেয়ে অর্চনা ও ছোট ছেলে সঞ্জয়। প্রথম স্ত্রীর ছেলে বিপুল মিস্ত্রি ঢাকায় একটি বেসরকারী কোম্পানিতে কর্মরত। মেজ ছেলে সুবির মিস্ত্রি গ্রামের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করেন। সূত্র জানায়, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে ৫/৬ বছর আগে বাবা শংকর মিস্ত্রির সঙ্গে অর্চনার তুমুল বিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে অর্চনা তার বাবার সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি ছাড়ে। পরবর্তীতে সে (অর্চনা) ফরহাদ মজহারের এনজিওতে চাকরি নেয়। অর্চনার প্রতিবেশীরা জানায়, বছরখানেক আগেও অর্চনা বাড়িতে এসে ৮/১০দিন থেকে কর্মস্থল ঢাকায় চলে যায়। ওই সময় অর্চনার সঙ্গে খুকু নামের আরেক নারীও বেড়াতে এসেছিল। খুকুকে ধর্মের বোন ডাকা হয়েছে বলেও সে সময় অর্চনা প্রতিবেশীদের জানায়। স্থানীয় কয়েক যুবক বলেন, গণমাধ্যমের খবর সূত্রে ধারণা করা হচ্ছেÑহৃদরোগে আক্রান্ত শংকর মিস্ত্রিকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার বাসায় নেয়ার পরেই অর্চনা তার ভ- গুরুবাবা ফরহাদ মজহারের কাছে টাকা চেয়ে ফোন করেছিল। পরবর্তীতে তার (ফরহাদ মজহার) পাঠানো ১৫ হাজার টাকা দিয়েই হয়ত শংকর মিস্ত্রির চিকিৎসা করানো হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মঠবাড়িয়া থানার দায়িত্বশীল এক পুলিশ অফিসার বলেন, ফরহাদ মজহার ও অর্চনা মিস্ত্রিকে নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ার পর অতিগোপনে থানা থেকে তারা তদন্ত করে জানাতে পেরেছেন অর্চনার সঙ্গে ফরহাদ মজহারের গভীর সম্পর্ক থাকলেও কখনও সে (ফরহাদ মজহার) অর্চনাদের গ্রামের বাড়ি সোনাখালীতে আসেনি। শুধু খুকু নামের এক অপরিচিত নারী অর্চনার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল। যাকে ধর্মবোন বলে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিল অর্চনা মিস্ত্রি।
×