ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তলিয়ে গেছে ফসলি জমি

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ॥ নদী ভাঙ্গনে বহু পরিবার নিঃস্ব

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ জুলাই ২০১৭

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ॥ নদী ভাঙ্গনে বহু পরিবার নিঃস্ব

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাঙ্গন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভিটামাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে বহু পরিবার ও মানুষ। বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি। এছাড়া পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। এবার ভাঙ্গন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের। টাঙ্গাইল থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, বৃদ্ধা শান্তনা ম-লের শেষ সম্বল ভিটাবাড়ি এখন হুমকির মুখে। যেকোন সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে তার ভিটাবাড়ি। তাই নদীর পারেই সব সময় বসে থাকেন কখন যেন তার সবকিছু কেড়ে নেয় ধলেশ্বরী। বর্ষা মৌসুমে নদীর ভাঙ্গন স্বাভাবিক ঘটনা হলেও টাঙ্গাইলে এবার যমুনা ও ধলেশ্বরীর ভাঙ্গন অতীত রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পানি বৃদ্ধি অপরিবর্তিত থাকলেও নদী রূপ নিয়েছে তীব্র স্রোতে। এ স্রোতে বসতভিটাসহ ফসলিজমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে তীরবর্তী এলাকাবাসী। এভাবে ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে শত শত পরিবার। সাধারণ মানুষ রয়েছে আতঙ্কে। কখন যেন শেষ সম্বলটুকুও চলে যায় নদীগর্ভে। যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি অপরিবর্তিত থাকলেও টাঙ্গাইলের চারটি উপজেলায় ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যেই গত কয়েকদিনে নাগরপুর উপজেলার মোকনা ইউনিয়নের আগদিঘুলিয়া গ্রামের সাধনা একাডেমিক হাইস্কুল, শত বছরের পুরনো আগদিঘুলীয় বাজার, কালীমন্দির, শ্মশানঘাটসহ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পড়েছে চরম বিপাকে। আর এভাবে ভাঙ্গতে থাকলে জেলার নাগরপুর, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল সদর ও ভূঞাপুর উপজেলার নদীপারের এলাকাগুলো বিলীন হয়ে যাবে অচীরেই। অপরদিকে ভাঙ্গনের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে আবাদিজমি, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র, বোরহান উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, নন্দপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পোস্ট অফিস, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতভিটা। ব্যবসায়ী আতাউর রহমান জানান, নদীগর্ভে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলীন হওয়ায় তিনি এখন প্রায় নিঃস্ব। বারবার স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে এ ভাঙ্গনরোধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। পিন্টু শীল, নয়ন শীল ও রিতা শীলসহ কয়েক এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, গত কয়েকদিনে নদীর তীব্র ভাঙ্গনে সবারই ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেছে। তারা কেউ কেউ থাকছেন অন্যের বাড়িতে। অথচ এখন পর্যন্ত কোন জনপ্রতিনিধি বা সরকারী কোন কর্মকর্তা তাদের খোঁজ নিতে আসেনি। এদিকে ভূঞাপুর উপজেলার ফকিরপাড়া, চরবেতুয়া, চর বামনহাটা, চর কুতুবপুর গ্রামে নতুন করে যমুনার পানি প্রবেশ করেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। অন্যদিকে পানি বৃদ্ধি অপরিবর্তিত থাকায় উপজেলার গাবসারা, গোবিন্দাসী, অর্জুনা ও নিকরাইল ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। অথচ এখনও এসব এলাকার মানুষের পাশে কোন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা পৌঁছেনি। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ জানান, ভাঙ্গনরোধে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফরিদপুর॥ জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ সে.মিটার বেড়ে রবিবার সকাল ৬টায় বিপদসীমার (৮.৬৫) ২০সে.মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পানির চাপে ফরিদপুরের সদরপুরে বসতভিটা, ফসলিজমি পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী ইউনিয়নের চর বলাশিয়াঘাট এলাকায় ভাঙ্গনের কবলে পড়া মানুষ তাদের বসতবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে। ওই এলাকায় আড়িয়াল খাঁ নদে তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। গত ১০ দিনে ওই এলাকায় ৪৪টি পরিবারের ভিটা ও ১৩২ একর ফসলিজমি পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গনের জন্য চর বলাশিয়া সিকদারবাড়ি জামে মসজিদ সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে চর বলাশিয়া মোল্লা গ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় । ওই এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ আলী শেখ জানান, আড়িয়াল খাঁ নদ চর বলাশিয়া ঘাটের পূর্বদিক পদ্মা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিম দিয়ে চর বলাশিয়াঘাট হয়ে মাঝে চর পড়ায় ইউ আকৃতির ধারণ করে আবার পূর্বদিকে চলে গেছে। চর পড়া আনুমানিক ৫০০ গজ জায়গা কেটে দেয়া হলে চন্দ্রপাড়া দরগা শরিফসহ চর বলাশিয়াঘাট ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, চর বলাশিয়াঘাট রক্ষার জন্য বালুর বস্তা ফেলা হবে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ওই এলাকায় ভাঙ্গন রোধে ৩২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জমা দেয়া আছে। সেই প্রকল্পে ওই জায়গাটি কাটার বিষয়টি যুক্ত আছে। মুন্সীগঞ্জ ॥ পদ্মার তীব্র স্রোত এবং ঘূর্ণাবর্তে লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার পদ্মার তীরবর্তী এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে ৩০টি বাড়ি। গত দুই-তিন দিনে নদী তীরবর্তী শতাধিক বাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। টঙ্গীবাড়ি উপজেলার কামারখাড়া ইউনিয়নের বড়াইল, চৌসার, বাগবাড়ি, জুসিষার গ্রামের ১০টি বাড়ি ইতোমধ্যে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। বড়াইল গ্রামের মসজিদটি শনিবার সন্ধ্যায় ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। ৫টি গ্রামের মানুষ ভাঙ্গন আতঙ্কে নিরাপদ স্থানে বাড়িঘর সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গত ৫দিন নদীর পানি বেড়ে গ্রামগুলোতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছে এসব গ্রামের মানুষ। টঙ্গীবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল হক জানান, সকালে কামারখাড়া ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর বর্তমান অবস্থা জেনেছি। মসজিদসহ ১০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি। এদিকে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গনে লৌহজংয়ের গাঁওদিয়া ইউনিয়নের গাঁওদিয়া, রানাদিয়া, হাড়িদিয়া, বড় মোকাম, শামুরবাড়ি পদ্মার ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। একদিকে বর্ষার পানি বৃদ্ধি অপরদিকে গত কয়েক দিনের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির প্রবোল স্রোত আর ঢেউয়ের কারণে প্রমত্তা পদ্মার রাক্ষুসে রূপ আবার জেগে উঠেছে। দেড় সপ্তাহে গাঁওদিয়া গ্রামের ২০টি বসতবাড়ি, ফসলিজমি, খেলার মাঠ, গাঁওদিয়া বাজারের কয়েকটি দোকান পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে গেছে গাঁওদিয়া গ্রামের রামা ডাক্তারের বাড়ির একটি অংশ। ভাঙ্গনের তীব্রতা এত বেশি যে বর্তমানে ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে জৈনপুরী পীরসাহেবের খানকা শরীফ, তার তৈরি একটি মসজিদসহ গাঁওদিয়া বাজারের মসজিদ, শামুরবাড়ির মসজিদসহ ৩টি মসজিদ, গ্রীন লাইন পরিবহনের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন বাচ্চুর নির্মিত একটি মাদ্রাসা, গাঁওদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, গাঁওদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ, বিখ্যাত লেখক মানিক বঙ্গোপাধ্যায়ের নানারবাড়ি, গাঁওদিয়া বাজারের বাকি অংশ, কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি খেলার মাঠ, ৪টি ক্লাব, শামুরবাড়ি, সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলির বসতবাড়ি, ইউনুছ খান মেমোরিয়াল হাসপাতাল, একটি মসজিদ, হাড়িদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, কবরস্থান ও প্রাইমারী স্কুল,ঐতিহ্যবাহী ডহরী বাজার। এর আগে প্রথম ’৯৩ সালে লৌহজং এলাকা ভাঙ্গনের কবলে পড়লে উপজেলার ধাইদা ইউনিয়নের গারুগাঁও, তেলিপাড়া, ধানকুনিয়াসহ একাধিক গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। এরপর প্রতিবছর বর্ষায় এই এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দেয়। ইতোমধ্যে ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম, জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনির হোসেন জানান, জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা ইতোমধ্যে লৌহজং উপজেলার নদী তীরবর্তী গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসন থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বেড়ে যায়। তবে এখনও পদ্মা বিপদসীমার নিচ দিয়ে বইছে। কুড়িগ্রাম ॥ জেলার ব্রহ্মপুত্র ও ধরলাসহ সবকটি নদনদীর পানি সামান্য হ্রাস পেলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ৫২ ইউনিয়ের সাড়ে ৫ শত পরিবারের প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ ১০ দিন ধরে পানিবন্দী থাকায় তাদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। ত্রাণ না পেয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে বেশির ভাগ পরিবার।
×