ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওসমানী মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২১ ও ১৪২২ প্রদান

শিক্ষার্থীদের মাঠ পর্যায়ের কৃষি সম্পর্কে ধারণা দিন ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৭ জুলাই ২০১৭

শিক্ষার্থীদের মাঠ পর্যায়ের কৃষি সম্পর্কে ধারণা দিন ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহরের গ-ির মধ্যে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের মাটির সংস্পর্শহীনতায় শঙ্কা প্রকাশ করে তাদের মাঠপর্যায়ের কৃষিকাজের বিষয়ে সম্যক ধারণা দেয়ার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা অন্ধ (বাস্তবতা বিবর্জিত) হয়ে যেন না থাকে সে বিষয়টাতে আপনাদের দৃষ্টি দিতে হবে।’ খবর বাসস’র। শেখ হাসিনা বলেন, ‘ধান কাটে বা ধান লাগায় এমন মৌসুমে আবশ্যই শিক্ষার্থীদের গ্রামে ওই ধানক্ষেতের পাশে নিয়ে যাওয়া উচিত। ছোটবেলা থেকেই তাদের বোঝানো উচিত এ দেশটা কিভাবে চলছে, খাদ্য কিভাবে আসছে।’ আজকাল শহরে যেসব ছেলেমেয়ে মানুষ হয়, তাদের অনেকে এসব সম্পর্কে জানতেও পারে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জানি না একদিন তারা হয়ত প্রশ্ন করবে- ধানগাছে তক্তা হয় কি-না। দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেমন আধুনিক বিশ্বের অনেক ছেলেমেয়েকে কোন ফল খাওয়া অবস্থায় এ ফলটা কোথায় পাওয়া যায় জিজ্ঞাসা করলে সে বলবে সুপার মার্কেটে পাওয়া যায়। কোথায় উৎপাদন হয়েছে- সে বিষয়টি তার মাথায়ই নেই। শেখ হাসিনা রবিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২১ এবং ১৪২২ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। দেশের কৃষি খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার প্রতি বছর এ পুরস্কার প্রদান করে আসছে। ১০টি শ্রেণীতে পাঁচটি স্বর্ণ, নয়টি রৌপ্য এবং ১৮টি ব্রোঞ্জপদক প্রদান করা হয়। পুরস্কার বিজয়ীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জনির্মিত পদক, নগদ অর্থের চেক এবং সনদপত্র গ্রহণ করেন। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মইনুদ্দিন আব্দুল্লাহ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন এবং পুরস্কার বিতরণী পর্বটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশী কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে সুস্থ থাকার জন্য মৌসুমি ফলমূল খাওয়ার বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে মৌসুমে যেসব ফলমূল পাওয়া যায়, এক্ষেত্রে প্রত্যেক ঋতুতেই দেশজ নতুন যেসব ফল রয়েছে সেসব খেলে সে সময়কার বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব হয়। সেসব রোগ-ব্যাধির জন্য প্রতিরোধক শক্তি এসব ফলমূলে রয়েছে। সঠিক সময়ে যথাযথ গবেষণালব্ধ উদ্যোগ গ্রহণে সক্ষম হওয়ায় দেশে দুধ, মাংস ও ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভেড়ার পশমের সঙ্গে পাটের সুতার মিশ্রণে উৎপন্ন বিভিন্ন পণ্যের জন্য আমি বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ ইনস্টিটিউটকে (বিএলআরআই) ধন্যবাদ জানাই। তারাই গবেষণা করে এটা বের করেছে। কম্বল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাংসারিক জিনিস এমনকি স্যুটের কাপড় পর্যন্ত তারা তৈরি করতে পারছে। তাদের এখন সুযোগ দিতে হবে এগুলো ভালভাবে বাজারজাত এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু দানাদার ফসল নয়; আলু, সবজি, ফল উৎপাদনেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তিনি বলেন, আমাদের মাটি খুব উর্বর, যে কারণে কোনকিছুর উদ্যোগ নিলেই কিন্তু সেটা উৎপাদন করতে পারি। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম, আলু আমরা বিদেশেও রফতানি করছি। উদ্বৃত্ত আলু রফতানি এবং শিল্প খাতে ব্যবহারে আমরা ২০ শতাংশ হারে সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে গবেষণা করে নতুন জাতের ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। তিনি উদাহরণ দেন- স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট, আঙ্গুর, মাশরুম থেকে শুরু করে অনেককিছু আমরা উৎপাদন করছি। দেশব্যাপী শিল্পের বিকাশে তার সরকারের এক শ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশে ক্ষুদ্র, মাঝারি, কুটির এবং বৃহৎ শিল্প স্থাপন করা। এজন্য এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। যে এলাকায় যে পণ্য ভাল হয় সেখানে সে ধরনের পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকারখানা গড়ে তোলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন আপদকালীন রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি রফতানিও করা যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত্রতত্র শিল্পকারখানা স্থাপন করে কৃষিজমি, বনভূমি যেন নষ্ট না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনে আমাদের সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বিজিআরআই’র (বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট) বিজ্ঞানীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, পাট হচ্ছে পরিবেশবান্ধব কৃষিপণ্য। বর্তমানে দেশে এবং বিদেশে পাট ও পাটজাতপণ্যের চাহিদা ও রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার পাটের সেই সুদিন ফিরে এসেছে। শেখ হাসিনা বলেন, আগে একজন দিনমজুর যা আয় করত তা দিয়ে একবেলার খাবারও কিনতে পারত না। এখন একদিনের মজুরিতে ১০-১২ কেজি চাল কেনা যায়। কারণ মজুরি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য তিনি সংসারের কাজ স্বামী-স্ত্রী দুজনকে ভাগ করে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এতে অনেক সময় যেমন সাশ্রয় হবে তেমনি পরস্পরের সান্নিধ্যে সময়টাও কেটে যাবে, যা দেশের অগ্রগতিতেও অবদান রাখবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ভৌগোলিক অবস্থানে বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। এজন্য আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে দৃষ্টি দিতে হবে। সেচ সম্প্রসারণের পাশাপাশি পানির ব্যবহার সীমিত রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে পানির অপচয় না হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন কৃষি তথ্যকেন্দ্র থেকে কোন জমিতে কতটুকু পানি প্রয়েজন, সে তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে তার সরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় তার সরকার প্রস্তুত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই জলবায়ু পরিবর্তনের কোন প্রভাব আমাদের দেশে যেন না পড়তে পারে, দেশের মানুষের জীবন যেন কোন রকম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে আমাদের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে এবং এ বিষয়ে দেশবাসীকেও সচেতন করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়Ñ এসবই আমাদের সম্পদ। এগুলো আমাদের সুপেয় পানির চাহিদা যেমন মেটায়, তেমনি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও ঠিক রাখে। প্রতি স্থাপনায় জলাধার নির্মাণের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই যে বাসস্থান করছি, ফ্ল্যাট করছি, প্লট করছি এবং শিল্পাঞ্চল করছি, এর প্রতিটি স্থানেই জলাধার তৈরি করছি। সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, মাটির চাহিদা, জলবায়ু- সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেব ও দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত করব। অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিজয়ীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের একটি রোল মডেল। তিনি বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং দারিদ্র্য ২২ শতাংশে নেমে এসেছে।
×