ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১৪ বছর আগে সাদ্দাম উৎখাত অভিযানের পর বর্তমান হালচাল

ইরানের প্রভাববলয়ে ইরাক

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১৭ জুলাই ২০১৭

ইরানের প্রভাববলয়ে ইরাক

ইরাকের বাজারে সওদা করতে গেলে দেখা যাবে সবকিছুই এখন প্রতিবেশী ইরানি পণ্যে ভরে আছে। দোকানের তাক দুধ, দধি ও মুরগিসহ ইরানি খাবারে পরিপূর্ণ। দেশটির টেলিভিশনে যেসব কর্মসূচী সম্প্রচার করা হচ্ছে, তাও ইরানের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। কোথাও একটি ভবন নির্মাণ হলেও তার সিমেন্ট ও ইট আসে ইরান থেকে। হতাশাগ্রস্ত ইরাকি যুবকরা মানসিক প্রশান্তি পেতে যে অবৈধ মাদক সেবন করে, তাও আসে ইরানি সীমান্ত থেকে পাচার হয়ে। সিরিয়া-লেবাননে লড়াইরত বাহিনীগুলোর জন্য জনবল ও অস্ত্র সরবরাহে ইরাকজুড়ে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ইরানি মিলিশিয়ারা। এমনকি বাগদাদে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও রয়েছে ইরানি আধিপত্য। মন্ত্রিসভায় কে আসবেন, আর কে বাদ পড়বেনÑ সব ঠিক করে দিচ্ছে ইরানি নেতারা। চৌদ্দ বছর আগে যখন সাদ্দাম সরকারের পতন ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে অভিযান চালায়, তখন দেশটিকে গণতান্ত্রিক সম্ভবনাময় হিসেবে দেখা হয়েছিল। এ যুদ্ধে ব্যাপক রক্ত ও অর্থ ক্ষয় হয়েছিল। প্রায় সাড়ে চার হাজার আমেরিকান নিহত হয়েছেন, খরচ হয়েছে এক লাখ কোটি ডলার। এরপর যুদ্ধ থেমে গেলে প্রথমদিন থেকেই ইরান ভিন্ন কিছু দেখতে চেয়েছে, ইরাককে একটি মক্কেল রাষ্ট্র বানাতে চেষ্টা করেছে। অথচ আশির দশকে দেশ দুটি এক নিষ্ঠুর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, যেখানে রাসায়নিক অস্ত্র পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছিল। ইতিহাসবেত্তারা যে যুদ্ধকে কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। সেই যুদ্ধে যদি ইরান জয়ী হতো, তবে ইরাক কোন দিন তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিত না। এর মধ্য দিয়ে পুরো অঞ্চলে ইরানের আধিপত্য ছড়িয়ে পড়তো। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যাবে শেষে এসে ইরান সত্যিই জিতেছে, হেরেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত তিন বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র কেবল ইরাকের ইসলামি স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওপর আলোকপাত করে গেছে। ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলে আইএস জঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়তে নতুন পাঁচ হাজার সেনা পাঠিয়েছে তারা। কিন্তু ইরান তার লক্ষ থেকে দৃষ্টি সরায়নি। প্রতিবেশী দেশে পুরোপুরি আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে ইরান। যাতে কোনদিন সেটি সামরিকভাবে তার বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে না ওঠে। এছাড়া ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে তেহরান পর্যন্ত কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে ইরাককে কাজে লাগাতে চায় ইরান। গত বছর অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে হোশায়ের জেবারিকে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ককে সন্দেহ করত ইরান। জেবারি বলেন, ইরানি আধিপত্য প্রবলতর হয়েছে। এটা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ইরাকে প্রতিবেশী ইরানের প্রভাবের কারণে পুরো অঞ্চলজুড়ে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোতে গোষ্ঠীগত উত্তেজনা তীব্রতর হয়েছে। ইরানি সম্প্রসারণবাদ রুখতে সৌদি আরব সংগঠিত হচ্ছে। এটা সত্যি যে ইরানের আধিপত্য বিস্তার আকাক্সক্ষার একটি অংশ মাত্র ইরাক। লেবানন, সিরিয়া, ইয়ামেন ও আফগানিস্তানসহ পুরো উপসাগরীয় অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে কখনো নরম কখনো শক্তভাবে ক্ষমতার ব্যবহার করে যাচ্ছে তেহরান। ইরান একটি শিয়া দেশ, ইরাকও শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ইরাক শাসন করতো অভিজাত সুন্নিরা। মুসলমানদের মধ্যে এই দুটি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের কারণ জানতে হলে চৌদ্দশ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। নবীর মৃত্যুর পর ইসলামের ন্যায়সঙ্গত নেতা কে হবেন, তা নিয়েই প্রথম বিবাদ তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমানে সেই বিভেদ ধর্মের চেয়ে ভূরাজনৈতিক সংঘাতের বড় অসিলা। আঞ্চলিক সংঘাতের একটি পক্ষে সৌদি আরব, অন্যটির নেতৃত্বে আছে ইরান। সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়সহ ইরাকের সবকিছুতে এখন ইরানের প্রভাব। দক্ষিণাঞ্চলের কোন কোন সীমান্তে ইরাকের সার্বভৌমত্ব নেই বললেই চলে। ইরাক থেকে তরুণ মিলিশিয়া সংগ্রহ করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইরানে পাচার করা হয়। এমনকি সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় তাদের কাগজপত্রও ঠিকমতো পরীক্ষা করা হয় না। এরপর এসব তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সিরিয়ায় পাঠানো হয়। সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পক্ষে ইরানি সামরিক অফিসারদের অধীনে তারা সেখানে যুদ্ধ করে। অন্যদিকে ট্রাকভর্তি ইরানি খাবার, গৃহসামগ্রী ও অবৈধ মাদক পাচার করা হয় ইরাকে। দেশটির এখন ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বাজারে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রেখেছে ইরান। এমনকি নাজাফ শহরে আবর্জনা অপসারণের ঠিকাদারি ইরানের ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে। পৌরসভার কাউন্সিল সদস্য জুহাইরি-আল-জিবুরি একটি প্রবচেনের কথা বলেন, আমরা ইরান থেকে আপেল আমদানি করি, যাতে তাদের তীর্থযাত্রীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারি। রাজনৈতিকভাবে ইরাকি পার্লামেন্টে ইরানের ব্যাপক সংখ্যক মিত্র রয়েছে। এতে দেশটিতে ইরান সহজেই যে কোন লক্ষ্য হাসিল করতে পারে। ইরাকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে হবেন, তা নির্ধারণে ইরান বিশাল ভূমিকা রাখে। আশির দশকে সাদ্দামকে প্রতিরোধে গড়ে তোলা একটি মিলিশিয়া বাহিনী ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বাহিনীতে প্রভাবে বিস্তারে ইরানকে সহায়তা করে। ইরাকে ব্যাপক রাজনৈতিক খেলা খেলছে ইরান। ইরাকি শিয়াদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, স্থানীয় মিত্রদের সঙ্গে তার বিশাল সংযোগ। অবস্থা এরকম যে, এখন ইরানের এক নির্ভরযোগ্য সমর্থক দেশ হতে যাচ্ছে ইরাক। -নিউইয়র্ক টাইমস
×