ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অবশেষে গর্জন কমছে যমুনায়, নামছে পদ্মার পানি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৬ জুলাই ২০১৭

অবশেষে গর্জন কমছে যমুনায়, নামছে পদ্মার পানি

স্টাফ রিপোর্টার॥ উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণের ধাক্কায় বাড়তে থাকা যমুনার পানি অবশেষে কমতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, শুক্রবার নদীর পানি স্থিতিশীল থাকার পর শনিবার থেকে কমতে শুরু করেছে। তবে তা এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উত্তরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কোন কোন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত যমুনার পানি হ্রাস অব্যাহত থাকবে। এই সময়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে তারা উল্লেখ করেন। এদিকে পদ্মা এবং কুশিয়ারা নদীর সমতলে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং ভারি বর্ষণের কারণেই কুশিয়ারা নদীর পানি ধীর গতিতে নামছে। ফলে ওই এলাকার বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে আগামী ৪৯ ঘণ্টা পর্যন্ত পদ্মার পানি বাড়লেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুরমার পানি সমতলে হ্রাস পেতে পারে। তবে কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, বোর্ডের সমতলে ৯০ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে শনিবার ১৬ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ ও কাজিপুরে যমুনার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার পানি গোয়ালন্দের কাছে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবার এ নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও উত্তরাঞ্চলে বন্যার পানি নেমে আসার কারণে পদ্মার পানি দ্রুত বাড়ছে। পদ্মার পানি বৃদ্ধির কারণে নিম্ন-মধ্যাঞ্চলে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। শনিবার এ অঞ্চলে নতুন নতুন এলকা প্লাবিত হচ্ছে। এদিকে ২ সপ্তাহ ধরে সুরমা, কুশিয়ারা নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার কুশিয়ারার পানি অমলশিদ, শেওলা এবং শেরপুর-সিলেট এলাকায় এবং সুরমা কানাইঘাট এলাকায় বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া গাইবান্ধায় ঘাঘট নদী, চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদ, বাঘাবাড়িতে আত্রাই নদী, এলাসিনে ধলেশ্বরী নদী, ঝিকরগাছাই কপোতাক্ষ নদ, দিরাইয়ে পুরাতন সুরমা এবং জারিয়াজাঞ্জাইলে কংস নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপে দেশের ৯০ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে শনিবার ৪৫ কেন্দ্রে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সিলেট ॥ দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় প্রথম দফা ২৬ হাজার ৭১৫ হেক্টর বোরো, দ্বিতীয় দফা ৪হাজার ৩৩০ হেক্টর আউশ, ৩৫ হেক্টর আমন এবং ৩শ’ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় সিলেটের ৮ উপজেলার ৫৫ ইউনিয়নের ৪৬৬ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৮৪৭ পরিবার। বন্যায় ১৩ উপজেলার সবক’টি হাওড়ের নিম্ন ও মধ্য এলাকার সকল বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এবারের বন্যায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ রাস্তাঘাটের এমনিতেই দৈন্যদশা। কুড়িগ্রাম ॥ জেলার বন্য পরিস্থিতি অপরির্বতিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি এখনও চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ধরলা,তিস্তা ও দুধকুমোর নদীর পানি হ্রাস পেলেও বন্যার পানিতে দীর্ঘদিন ঘর-বাড়ি তলিয়ে থাকায় দুর্ভোগ বেড়েছে চরাঞ্চলের মানুষের। চরাঞ্চলে চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। নৌকা বা নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ শুনলেই ত্রাণের জন্য ছুটে আসছে বানভাসি মানষ। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকার ২ শতাধিক চর ও দ্বীপচরের বানভাসি মানুষ ১০ দিন ধরে পানিবন্দী থাকায় তীব্র খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে তারা। জেলার ৭ উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের ৫শতাধিক গ্রামের প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। টাঙ্গাইল ॥ বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে যমুনাপারের কয়েক হাজার মানুষ। জেলা সদর, গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, দেলদুয়ার ও নাগরপুর উপজেলার চরাঞ্চল এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। গত ২৪ ঘণ্টায় ভূঞাপুর উপজেলার অর্জুনা, চুকাইনগর, গোবিন্দাসী, ভালকুটিয়া, কষ্টাপাড়া, ইদুলিয়াবাড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে। ভূঞাপুর পৌর এলাকার ফকিরপাড়া, চর বেতুয়া, চর বামনহাটা, চর কুতুবপুর গ্রামে নতুন করে যমুনার পানি প্রবেশ করেছে। ভূঞাপুর, কালিহাতী ও গোপালপুর উপজেলার ৩০টির বেশি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার বহু মানুষ ঘরের মালামাল ও গবাদিপশু দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে বাঁধ এবং বাঁধের পূর্বপারের উঁচু জায়গায়। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিনভর তারা ওই সব মালামাল স্থানান্তর করছে। রাজশাহী ॥ পদ্মার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। মহানগরীসহ জেলার গোদাগাড়ী, বাঘা উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় এরই মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। বিলীন হয়ে গেছে কয়েক শ’ বিঘা আবাদী জমি এবং গাছপালা। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাঙ্গনে শঙ্কিত জেলার ২৫ গ্রামের মানুষ। পানির তোড়ে গোদাগাড়ীর সারাংপুর, গাঙোবাড়ি ও সুলতানগঞ্জ এলাকায় পদ্মার পার ভাঙ্গছে। এছাড়া ভাঙ্গতে শুরু করেছে বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের আলাইপুর, পানি কামড়া ও চরকালদাসখালি এলাকায়। এরই মধ্যে এসব এলাকার কয়েক শ’ বিঘা আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভেসে গেছে অনেক গাছপালাও। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে পদ্মার পানি বিপদসীমার ১৮ দশমিক ৫০ মিটার ওপর। ফরিদপুর ॥ গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মার পানি গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৬ সেমি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানির চাপে ধসে পড়েছে কাঁচা সড়ক, ডুবে গেছে ক্ষেতের ফসল। সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নে পানির তোড়ে ইউনিয়নের কাজেম মাতুব্বরের ডাঙ্গি, ব্যাপারিডাঙ্গি এবং ম-লডাঙ্গি এলাকায় দুটি কাঁচা সড়ক বিভিন্ন জায়গায় ধসে গেছে। তিনটি গ্রামে আনুমানিক চার শ’ একর আমন ও আউশ ধান তলিয়ে গেছে। পদ্মার ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে গোলডাঙ্গি মসজিদ। চরভদ্রসনের চর হরিরামপুরে দুই শ’ একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ২৬টি পরিবার। গাইবান্ধা ॥ ৪ উপজেলার সার্বিক বন্যার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দী মানুষ শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ নানা সমস্যার কবলে পড়েছে। অনেক এলাকায় নদী ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট এলাকার ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। এরমধ্যে ব্যাপক ভাঙ্গনের ফলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বন্যার পানির স্রোতে কামারজানি ইউনিয়নের কলমু এসএমসি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেবে গেছে। সিরাজগঞ্জ ॥ পানি কমলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। দুপুরে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন,রাজনৈতিক দলের নেতাসহ মিডিয়া কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বন্যায় জেলার ৫০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৪টি ইউনিয়ন। জেলার বেলকুচি, শাহজাদপুর, কাজিপুর, সদর ও চৌহালী উপজেলার ২৪৭টি গ্রামের ৪৭ হাজার ৬৬০ পরিবার বন্যায় ক্ষতিগস্ত।
×