ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বছর বছর বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও সুফল নেই ॥ মন্ত্রী শোনালেন আশার বাণী

জলজটে চট্টগ্রামবাসীর ভয়াবহ দুর্ভোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৬ জুলাই ২০১৭

জলজটে চট্টগ্রামবাসীর ভয়াবহ দুর্ভোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চলমান বর্ষা মৌসুমে অতি, ভারি, মাঝারি কিংবা হালকা বর্ষণে চট্টগ্রামের যে জলজট পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আকাশে মেঘ হয়ে বর্ষণ ঘটলেই নগরবাসীর কপাল পুড়ছে। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত যে জলজট পরিস্থিতি দৃশ্যমান তা নিয়ে ক্ষোভে ফুসছে নগরীর সর্বস্তরের মানুষ। বছরের পর বছর ধরে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে আছে। বর্ষণের পানি নগর থেকে নিষ্কাষিত হওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকাই এর মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে প্রতিবছর এ যাতে কম-বেশি বরাদ্দ এসেছে। এ নিয়ে প্রকল্পও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এ প্রকল্পের বিপরীতে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে তা পানিতেই গেছে। মহানগরীর অভ্যন্তরে ছোট বড় ৪০টিরও বেশি যে খাল রয়েছে এসব খাল সমতলের সঙ্গে সমান হয়ে খাল বা নালা বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই বললে চলে। যে চাক্তাই খাল দিয়ে অতীতে ব্যবসা বাণিজ্য ব্যাপকভাবে পরিচালিত হতো সেই খালে এখন কোন নৌযান চলে না। উজান থেকে পলি মাটি ক্রমাগতভাবে যেমন নামছে, তেমনি নগর থেকে বর্জ্য অপসারিত হয়ে তা কর্ণফুলী নদীকে কেবলই গ্রাস করছে। ফলে এ নদীও মরতে বসেছে। যদিও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সাম্প্রতিক সময়ে বাকলিয়া থেকে কর্ণফুলী নদী খনন প্রকল্প গ্রহণ করেছে তা এখনও ফাইল চালাচালীতেই রয়েছে। এমন অবস্থায় গৃহায়ন ও পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন শোনালেন আশার বাণী। শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত নান্দনিক চট্টগ্রামের নন্দিত নাগরিক শিরোনামে মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী জানালেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার স্থায়ী নিরসনে সরকার ৬ হাজার কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। মন্ত্রীর এ বাণীটি নগরবাসীকে আশাবাদী করেছে সত্য, কিন্তু এ প্রকল্প কবে নাগাদ নেয়া হবে এবং তা বাস্তবায়নের সময় কতদিন তা খোলাসা করেননি। এরপরও মানুষ আশায় বুক বেঁধে আছে এই বলে যে, জলাবদ্ধতার ভয়াবহ এ দুর্ভোগ থেকে চট্টগ্রামবাসী আগামীতে মুক্তি পাবে। আবার বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে এ কথাও বলা হচ্ছে, এসব আশার বাণী নিয়ে মানুষের মাঝে দোল খেলেও বহুক্ষেত্রে তা কথার কথা হয়ে যায়। অতীতে এমনও ঘটনা ঘটেছে বহুবার। সে চাক্তাই খাল। যেটিকে চট্টগ্রামের দুঃখ বলে আলোচিত হয়ে আসছে এবং সেই চাক্তাই খাল খননের জন্য কয়েক দশকে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ফলাফল এসেছে উল্টো। যা দুর্ভোগই বাড়িয়েছে। নগরীর বিভিন্ন খালের বিভিন্ন পয়েন্টে চসিকের উদ্যোগে খাল খননের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে উত্তোলিত মাটি খালের পাড়েই রাখার কারণে তা আবার নেমে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতি প্রতিটি খালের ক্ষেত্রে ঘটেছে বলেই বর্তমানে এসব খাল অনেকাংশে নালায় রূপ নিয়েছে। আর নালাগুলো সড়কের চেহারায় আবির্ভূত হয়ে আছে। যার কারণে বর্ষা মৌসুম এলে যে কোন ধরনের বর্ষণে নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যায়, বর্তমানে প্লাবন পরিস্থিতি নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোকেও গ্রাস করছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম মূলত পাহাড়ী এলাকা। পাহাড় থেকে বৃষ্টির সঙ্গে মাটি নেমে আসে। মাঝে মাঝে পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটে। এর সঙ্গে প্রাণহানিত রয়েছেই। কিন্তু এসব কাদা মিশ্রিত পানি নিষ্কাশিত হওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বর্তমানে অনুপস্থিত। ফলে জলজটের কবলে পড়ে মানুষের সহায় সম্পদের ক্ষতির পাশাপাশি দুর্ভোগ তিমিরেই চলে যাচ্ছে। মন্ত্রীর এ নিয়ে আশার বাণী শোনানোর আগে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন জানিয়েছেন, চসিকের কার্যক্রমে ৩ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে উর্ধতন মহলের অনুমোদন কখন আসবে তা অনিশ্চিত। এ অবস্থায় মন্ত্রীর নতুন আশার বাণী যে, স্থায়ী জলাবদ্ধতার হাত থেকে নগরবাসীর পরিত্রাণে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প আসছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রতিবছর প্রতিটি সরকার আমলে বর্ষণ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম যখন অথৈই পানির নিচে চলে যায় তখন নতুন নতুন প্রকল্পের কথা ঘোষণা হয়, আশার বাণী পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তীতে এসব ঘোষণা ও আশার বাণী কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য চসিকসহ বিভিন্ন মহল এ দুর্ভোগের কারণ হিসেবে দুষলেও সেদিকে কঠোর নজরদারি আরোপ না করে বড় অঙ্কের বরাদ্দ দিয়ে খাল কাটার সুব্যবস্থা যদি আদৌ করে দেয়া হয় তাতেও কোন সুফল মিলবে না বলে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রের অভিমত। কেননা, এমন একটি খালও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেটি এটির মূল চেহারা থেকে ভিন্ন চেহারায় রূপ নিয়েছে। খালগুলোর দু’পাশজুড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। এসব স্থাপনা অপসারণ না করে খালগুলোর অতীত চেহারা ফিরিয়ে না দিলে কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয়ে কি সুফলতা আসবে সে প্রশ্নটি বার বার উঠলেও সেদিকে কারও যেন কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকার জনগণের ট্যাক্স থেকে বড় বড় প্রকল্পের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ দিয়েই যাচ্ছে। চট্টগ্রামও এর বাইরে নয়। কিন্তু এসব অর্থ খরচ করে লাভের বদলে ক্ষতিটাই যেন বেশি আসছে। যেহেতু চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং বাণিজ্যিক নগরী বলেও খ্যাতি রয়েছে, সেই চট্টগ্রাম নগরী বর্তমানে জলজট পরিস্থিতি নিয়ে একাকার হয়ে আছে। বেসরকারী ও বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ চট্টগ্রামে অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেকাংশে বেশি। এছাড়া বর্তমান সরকারও বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা- চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক করতে বাধ্য হয়েছে। কেননা, বিদেশী বড় বড় উদ্যোক্তারা ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের এলাকাগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে সর্বশেষ কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, সীতাকু- ও আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজটিও শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মূল সমস্যায় হাত না দিয়ে চসিক ও চউক যেসব অপরিকল্পিত উন্নয়নের কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে তা আগামীতে হয়ত আরও বড় ধরনের দুর্ভোগ বয়ে আনার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রামে উন্নয়ন কর্মকা-ের ফিরিস্তি দীর্ঘ ছাড়া কম হবে না। কিন্তু এরপরও কেন এই পরিস্থিতি। এ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতি ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে যেমন মানুষ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না, তেমনি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে প্রাধান্য না দিয়ে কোন কোন মহলের ইচ্ছামাফিক নগর উন্নয়ন কর্মকা- নগরবাসীর ভবিষ্যতকে বিপজ্জনক করে তুলছে। ফ্লাইওভার প্রকল্প যার অন্যতম বলে দফায় দফায় আওয়াজ উঠেছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে কার কথা কে শোনে। কোন সমন্বয় নেই। জলে ডুবে মানুষ মরছে। সহায় সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে যাচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে কথিত উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্মকা- অব্যাহত থাকায় সুফলতার চেয়ে দুর্ভোগই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এরপরও সেবা সংস্থাগুলোর অবস্থানে কোন হেরফের ঘটছে না। উন্নয়নের নামে যত পরিকল্পনা দেয়া হয় তা অনুমোদন করিয়ে আনতে একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা আগেভাগে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অনুমোদিত হওয়ার পর বাস্তবায়নের পথে অসাধু আরও বিভিন্ন চক্র এতে ভাগ বসাচ্ছে। ফলে প্রকৃত অনুমোদিত অর্থের অর্ধেকেরও বেশি পরিমাণ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চলে যাচ্ছে। আর যে অর্ধেক বাস্তবায়ন হচ্ছে তা অপরিকল্পিত হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কেবলই বেড়েই চলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এসব ঘটনা কিভাবে হতে পারে। অনাকাক্সিক্ষত কর্মকা- যেমন মানুষ চায় না, তেমনি অপরিকল্পিত নগরায়নও কাম্য হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এ জাতীয় ঘটনায় বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। শত শত কোটি টাকা যাচ্ছে পানিতে। আবার যাচ্ছে দুর্নীতিবাজদের পকেটেও। এতে করে জনদুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর এ পরিস্থিতির বিস্তৃতিই ঘটছে। অতীতে যারা কখনও নিজেদের বাড়ি ঘরে প্লাবিত হতে দেখেনি তারা এখন অনাকাক্সিক্ষত এ পরিস্থিতির শিকার হয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছে। চলতি বর্ষা মৌসুম শেষে অবশ্যই কিছু কাজ হাতে নেয়া হবে। কিন্তু আগামী বর্ষা মৌসুম এলেই সেই কর্মকা-ের সুফলতা দেখার চেয়ে দুর্ভোগই যেন নেমে আসে। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, সমন্বিত উদ্যোগ ও যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করে বছরের পর বছর এভাবে যত অর্থই ব্যয় করা হোক না কেন তা পানিতেই চলে যাবে।
×