ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অপ্রতিরোধ্য ৩০ সিন্ডিকেট

উখিয়া থেকে আড়াই লাখ পিস ইয়াবাসহ সাত ব্যক্তি গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৬ জুলাই ২০১৭

উখিয়া থেকে আড়াই লাখ পিস ইয়াবাসহ সাত ব্যক্তি গ্রেফতার

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ স্থল ও নৌপথে অভিযান অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই ইয়াবার চালান রোধ করা যাচ্ছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন অভিযান চালিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের আটক করতে সক্ষম হলেও সর্বদা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা। বর্তমানে সীমান্ত এলাকাসহ পর্যটন শহরে সবচেয়ে সহজলভ্য পণ্য হয়ে উঠেছে ইয়াবা। শনিবার ভোরে পৃথক অভিযানে প্রায় আট কোটি টাকা মূল্যের দুই লাখ ৫৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ সাত ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ ও কোস্টগার্ড। সূত্র জানায়, ইয়াবা বহনে সুবিধা হওয়ায় এর প্রতি বেশি ঝুঁকছে উঠতি বয়সী কিশোর-যুবকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেছেন সচেতন মহল। এ সুযোগে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। শনিবার ভোরে উখিয়া হাইওয়ে পুলিশ ও কোস্টগার্ড উদ্ধার করেছে দুই লাখ ৫৬ হাজার পিস ইয়াবা। এসব ইয়াবার মূল্য ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। শনিবার ভোরে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বালুখালী কাস্টমস (উখিয়ার ঘাট) এলাকায় হাইওয়ে পুলিশ একটি ট্রাকে তল্লাশি চালিয়ে দুই লাখ ৫৫ হাজার পিস ইয়াবা ও দুই ইয়াবা সরবরাহকারীকে আটক করেছে। মাদকের এ বড় চালানের গডফাদার টেকনাফের হ্নীলা রঙ্গিখালীর হেলাল ও ইদ্রিছ সিন্ডিকেটের বলে তথ্য মিলেছে। আটকরা হলো- যশোরের শার্শা উপজেলার কালিয়ানি এলাকার আব্দুর রশিদের ছেলে মোহাম্মদ মিন্টু আলী ও মশিউর রহমানের ছেলে দেলোয়ার হোসেন। ধৃতদের বিরুদ্ধে মাদক প্রতিরোধ আইনে মামলা হলেও এসব চালানের গডফাদার কারা, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়নি পুলিশ। মিয়ানমার থেকে কারা ইয়াবার বড় বড় চালান নিয়ে আসছে, কারা অল্প দিনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে, যাদের কারণে ইয়াবার চালান সম্পূর্ণ রোধ করা যাচ্ছে না, তা টেকনাফ ও উখিয়া থানা পুলিশের কমবেশি জানা রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে কতিপয় অসৎ পুলিশের কাছে মাসোয়ারা পৌঁছানো হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে, যার কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা। তবে ইতোপূর্বে জেলা পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলার প্রতিটি থানা পুলিশকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। টেকনাফ ও উখিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় অন্তত ৩০টিরও বেশি ইয়াবা সিন্ডিকেট রয়েছে। ওসব সিন্ডিকেটের মধ্যে টেকনাফের সাইফুল করিম, হ্নীলার জামাল মেম্বার, বাবুল মেম্বার, আবু তৈয়ব, রশিদ, ছকু, রোস্তম, ফরিদ আলম, ফয়সাল, নুরুল হুদা, নাসির সিকদার, শাহ আলম, ইউনুছ, বেলাল, হ্নীলা পুরান বাজারের নুরুল আমিন (রোহিঙ্গা), জাফর আলম (কালাইয়া), আনোয়ার, পুতিয়া মেস্ত্রী, রেজাউল করিম (কালু), ফজল করিম মেম্বার এবং উখিয়ায় মাহমুদুল করিম, বকতার মেম্বার, জাহাঙ্গীর, এনামুল হক, নুরুল আমিন মেম্বার, ফারুক, জয়নাল মেম্বার, কামাল, জাহাঙ্গীর আলম, আবু তাহের ভুট্টো, কলিমুল্লাহ ওরফে লাদেন ও গোয়ালিয়ার মোস্তাক সিন্ডিকেট অন্যতম। অভিযোগ উঠেছে, নুরুল আমিন মেম্বার, ফারুক ও মোস্তাক কতিপয় অসৎ পুলিশের সঙ্গে সখ্য রেখে ইয়াবার চালানের সংবাদ দিয়ে জব্দের পরবর্তীতে ওই চালান বিক্রি করে ভাগ-বাটোয়ারা করে থাকে। প্রশাসনের লোকজন ইয়াবাবিরোধী অভিযানে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় নুরুল্লাহ চৌকিদার ওসব গডফাদারকে আগাম সংবাদ দেয় বলে সূত্র জানিয়েছে। ওসব সিন্ডিকেটে কমপক্ষে ৮-১০ জন করে সদস্য রয়েছে। এদের কাছে অবৈধ অস্ত্রও রয়েছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ইয়াবার চালান প্রবেশ করানোর সময় ওসব অস্ত্র সঙ্গে রাখে তারা। এদিকে, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড সদস্যরা শহরের কস্তুরাঘাটে ফিশিং ট্রলারে তল্লাশি চালিয়ে এক হাজার ৪৫ পিস ইয়াবা জব্দ ও চট্টগ্রামের আনোয়ারার আব্দুস সবুর, বজল আহমেদ, আব্দুস সোবহান, নুরুল ইসলাম ও ইউনুসকে আটক করেছে। চিহ্নিত কয়েকজন গডফাদারের সঙ্গে এক শ্রেণীর অসৎ পুলিশের সখ্য থাকায় অভিযানের আগাম বার্তা তারা পেয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রাজেশ বড়ুয়া জানান, উত্তরবঙ্গের সংঘবদ্ধ চক্র টেকনাফের ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে আঁতাত রেখে ইয়াবার চালান নিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। অবশেষে শনিবার ইয়াবার চালান বহনকারী খালি ট্রাকটি চ্যালেঞ্জ করে ট্রাকের আলাদা বাক্স থেকে এসব ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। সচেতন মহল জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ইয়াবার অসংখ্য চালান ধরা পড়লেও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠায় ইয়াবার আগ্রাসন রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সমুদ্র ও স্থলপথে ইয়াবার চালান সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন রোধে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। প্রত্যেহ ছোট-বড় একাধিক চালান ধরা পড়লেও ইয়াবা সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক অক্ষতই থাকছে- এমন প্রচার রয়েছে। ফলে রঙ্গিন এ নেশার ট্যাবলেটের নীল ছোবলে ধ্বংস হচ্ছে যুবসমাজ। ইয়াবা সেবনের মধ্যদিয়ে মাদকাসক্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতাও। প্রসিদ্ধ চোরাচালানিরা মরণ নেশা ইয়াবা মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করিয়ে সরবরাহ করছে সারাদেশে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্ত হয়ে প্রচুর ইয়াবা পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসছে। ইয়াবার চালান বন্ধে টেকনাফ থেকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ জরুরী হয়ে পড়েছে। সাগরপথে মাছ ধরার ট্রলারে সরাসরি মিয়ানমার থেকে বড় বড় ইয়াবার চালান দেশে ঢুকে পড়ছে। আসছে সড়কপথেও। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া ওসব চালান ধরতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এক্ষেত্রে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্টগার্ড সদস্যদের তৎপরতার গাফিলতি নেই। তারপরও ভয়াল ইয়াবা আগ্রাসনের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে প্রশাসন। সচেতন মহল আরও জানান, সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি না হলে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এখন যুবসমাজের হাতে হাতে ইয়াবা। ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটায় তা বন্ধ করা এখন দুরূহ বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই যুবসমাজকে বাঁচাতে প্রশাসনের তৎপরতার পাশাপাশি গণসচেতনতা ছাড়া ইয়াবা প্রতিরোধে বিকল্প নেই বলে জানান তারা।
×