ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অমিল ঘুচে গেছে প্রান্তিক জনপদ আর নগরে

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১৫ জুলাই ২০১৭

অমিল ঘুচে গেছে প্রান্তিক জনপদ আর নগরে

চলমান ডিজিটাল যুগে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে শহর থেকে গ্রামীণ জনপদে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ৮০ভাগ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান। এখন অজপাড়া গাঁয়ের শিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, চাষী-জেলে, কামার-কুমার সকলেই শহরের মতো ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। যা এক দশক আগেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ছিল অধরা। গ্রামীণ জনপদে অবকাঠামো উন্নয়নের সুবাদে ঘরে বসে হাত বাড়ালেই মিলছে সবকিছু। তৃণমূল পর্যন্ত নতুন নতুন রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, হাসপাতাল, সাইক্লোন শেল্টার, বিদ্যুত সংযোগ, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স এবং তথ্য-প্রযুক্তিসহ ই-সেবা কেন্দ্র চালু হওয়ায় এখন আর শহর ও প্রান্তিক জনপদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। গ্রীষ্ম-বর্ষাসহ সকল মৌসুমে গ্রামের মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এক কথায় সেকালের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী একালে ডিজিটাল স্বর্ণযুগে বসবাস করছে। সুখ-সাচ্ছন্দ্যের মধ্য থেকে অনেকে ভুলে গেছে অন্ধকার জীবনের গল্প। এক সময় মৌলিক চাহিদা বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ছিল অন্ধকারে। তখন যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে ছিল একমাত্র নদী পথ। কাঁচা-পাকা কোন রাস্তা ছিল না। হাঁটা-চলাফেরার জন্য ছিল ক্ষেতের আইল, হালট ও মেঠোপথ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় তা ছিল শুধু নদীপথ। যা আদিম যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সে সময় কার্পেটিং রোড, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার পাকা ভবন, হাসপাতাল, সাইক্লোন শেল্টার, বিদ্যুত সংযোগ, ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন এসব গ্রামীণ জনপদে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ছিল স্বপ্নাতীত। আর গ্রামের বাড়িতে ঘরে বসে তথ্য-প্রযুক্তিসহ ই-সেবা পাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেনি। শুষ্ককালের চেয়ে বর্ষায় এদেরকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। খাদ্য সঙ্কট, নানা পানিবাহিত রোগ-ব্যাধিতে ওষুধ সঙ্কট, বিশুদ্ধ পানির অভাবসহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসত তাদের জীবনে। অনেকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। দুঃখ-দুর্দশা আরও বেড়ে গেছে বর্ষার পরে। এখনও ২০ ভাগ প্রান্তিক মানুষ ঝড়-বন্যা-ভাঙনসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। বিশেষ করে বর্ষায় প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ভাঙা-গড়ার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। ডিজিটাল যুগেও এ সব অধিকার বঞ্চিত চরের প্রান্তিক চাষীদের কাছে ডিজিটাল শব্দটা অধরাই রয়ে গেছে। তারা বর্ষায় সেকাল-একালের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পায় না। শুধু বর্ষা নয় এক সময় বছরের ছয় মাস এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও যোগাযোগের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। বর্ষাকালে নদ-নদী-বিল পাড়ি দিয়ে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা স্কুল মাদ্রাসায় যাতায়াত করেছে। নৌকা ডুবিতে কখনও তাদের জামা-কাপড় বই-পুস্তক ভিজে গেছে। এ কারণে সময় ক্ষেপণের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকিও ছিল অনেক বেশি। নৌকা ডুবিতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে। কয়েক দশক আগে গ্রামগঞ্জে কোন কলেজ বা কোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাই গ্রামের ছেলে-মেয়েদের ১৫/২০ কিমি. দূর থেকে এসে শহরের কলেজে লেখাপড়া করতে হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পাড়, ক্ষেতের আইল ও মেঠোপথে হেঁটে শহরের কলেজে যাতায়াত করতে হয়েছে। বর্ষাকালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা কলেজে আসত নৌকা বা কলাগাছের ভেলায় চড়ে। কোন কোন নদ-নদীতে খেয়া পারাপার করে যাতায়াত করতে হতো। রাত ৮টার পরে খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে। রাতে কেউ অসুস্থ বা বিপদগ্রস্ত হলে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করেই নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া নিয়েও ভোগান্তি হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে ঘাটে খেয়া নৌকা না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের ঠিক সময়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বা শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হওয়া নিয়েও পড়তে হতো বিপাকে। দেশে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেও চরাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ এখনও সেকালেই রয়ে গেছে। যোগাযোগের জন্য সাধারণ মানুষ বছরের ছয় মাসই নৌকার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তখন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে কিংবা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে গেলে মানুষের গায়ে রীতিমতো জ্বর উঠেছে। তখন হাটবাজার, অফিসিয়াল কাজ ও কোর্ট-কাচারীতে মামলা মোকদ্দমার জন্য বর্ষায় নৌকা এবং শুষ্ক মৌসুমে হেঁটে যাতায়াত করতে হয়েছে। সেকালে গ্রামীণ জীবনে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই দুর্গম ছিল যে, তখন দূরের আত্মীয়-স্বজনের খবরা-খবর বা কুশল বিনিময়ের কোন মাধ্যম ছিল না। স্বাধীনতা অর্জনের পর আশির দশক পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সেকেলে। আশির দশক থেকে নব্বই দশকে যোগাযোগ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। উপজেলার প্রবর্তন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কারণে অজপাড়া গাঁয়ে অবকাঠামো নির্মাণ, নতুন নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ফলে গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগসূত্র তৈরি হতে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। গ্রামের উৎপাদিত পণ্য সহজেই শহরে বাজারজাত হচ্ছে। ২০০৯ সালের প্রথম থেকেই পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। এখন শুধু যোগাযোগ নয়, সর্ব ক্ষেত্রে উন্নয়নের স্বর্ণযুগে বসবাস করছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এখন শহর ও গ্রামের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না। আমূল পরিবর্তন এসেছে যোগাযোগ ক্ষেত্রে। গ্রামের মানুষ ঘরে বসে ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। বর্তমানে জেলায় তিন হাজার আটশ’ কাঁচা-পাকা সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ৮৪ কিমি. জাতীয় সড়ক, ২০ কিমি. সড়ক-মহাসড়ক এবং ৭৬ কিমি জেলা সড়ক। এলজিইডি বিভাগের ১১শ’ কিমি. পাকা আঞ্চলিক ও সংযোগ সড়ক এবং ২ হাজার ৪২৭ কিমি. কাঁচা রাস্তা রয়েছে। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×