ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাখির ডাকে আর ঘুম ভাঙ্গে না

বর্ষায় বদলে গেছে গ্রাম

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৫ জুলাই ২০১৭

বর্ষায় বদলে গেছে গ্রাম

এখন থেকে ঠিক পাঁচ কিংবা আরও তিন বছর বাড়িয়ে আট বছর আগের বর্ষাকালে গ্রামের চিত্র নিয়ে ভাবতে গেলে সবার আগে যে চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠবে তা হলো মাইলের পর মাইল কাদাময় রাস্তা। সারা বছর ধূলিময় রাস্তা বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে হয়ে গেছে কাদাময়। কোথাও এক হাঁটু কাদা তো কোথাও কোমর পর্যন্ত। বর্ষাকালের যানবাহন বলতে শুধু গরু-মোষের গাড়ি। বছরের অন্যান্য সময় পায়ের গোড়ালি ডোবা ধুলাময় সড়কে সাইকেল চললেও বর্ষার শুরুতেই বাইসাইকেলের ঠাঁই হয়েছে ঘরের কোনে। বিশেষ করে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের এঁটেল লাল মাটি বর্ষায় বৃষ্টির ছোঁয়ায় গলে আঠালো রূপ নিত। তখন হেঁটে চলাচলও ছিল দুষ্কর। তার পরেও মানুষ প্রয়োজনে মাইলের পর মাইল হেঁটে কাদা পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে গেছে। আর এখন বদলে গেছে সবকিছু। গ্রামের আর কোন রাস্তায় সেই কাদা নেই। প্রতিটি গ্রামে এখন উন্নয়নের ছোঁয়া। দ্রুত পরিবর্তন হয়ে কাদাময় রাস্তা বদলে হয়েছে পিচঢালা পথ। বর্ষায় আর সাইকেল তুলে রাখতে হয় না। সব ধরণের যানবাহন চলাচল করে গ্রামের পাকা সড়কে। কি বর্ষা, কি গ্রীষ্ম সব সময় যানবাহনের আওয়াজ গ্রামের রাস্তাতেও। মাইলের পর মাইল আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথ ঠেকেছে উপজেলা থেকে উপজেলা, জেলা শহর এমনকি গ্রাম থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সংযোগ সড়ক কোথাও বাদ নেই। এখন শখের বসে রাজশাহী অঞ্চলের কেউ গ্রামের কাদাময় রাস্তা খুঁজতে গেলেও পাওয়া দুষ্কর। বর্ষা মানে এক হাঁটু কাদায় পূর্ণ রাস্তা এখন আর নেই বললেই চলে। এখন সেইসব গ্রামীণ রাস্তা পাকা। বদলে যাওয়া এসব রাস্তা পাকা হয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা আর যাতায়াতে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে। রাজশাহীসহ বরেন্দ্রের প্রায় সব উপজেলার গ্রামে গ্রামে পিচঢালা আন্তঃসড়ক বদলে দিয়েছে গ্রামের চিত্র। এর সঙ্গে বদলে গেছে গ্রামের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। বর্ষাকালে গ্রামের রাস্তা-প্রসঙ্গ উঠতে তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সরকার বললেন, বিরানব্বই সালের আগে তানোর উপজেলায় এক ইঞ্চি রাস্তাও পাকা ছিল না। সে সময় উপজেলা সদরে কেবল ইট বিছানো রাস্তা ছিল। গাড়ি-ঘোড়া চলত না। তখন গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার জন্য কমপক্ষে দুু’দিন আগে থেকে পরিকল্পনা করতে হতো। বর্ষাকালে কমপক্ষে আট মাইল কর্দমাক্ত পথ হেঁটে আমনুরা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতে হতো। এখন সে সবের বালাই নেই। রাত-বিরেত কোন কথা নয়, ইচ্ছে হলেই যেখানে সেখানে চলাচল করা যায় অনায়াসে। তিনি বলেন, এখন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের সংযোগ সড়কও পাকা হয়ে গেছে। ফলে বর্ষার সেই কাদা আর চোখে পড়ে না। হাতে তুলতে হয় না আর পায়ের স্যান্ডেল-জুতা। একই উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, পাকা রাস্তা বদলে দিয়েছে গ্রামের মানুষের জীবনচিত্র। গ্রামের কৃষক উৎপাদিত ফসল শহরে গিয়ে বিক্রি করে ন্যায্য দাম পাচ্ছে। যাতায়াতে সময় ও খরচ দুই-ই সাশ্রয় হচ্ছে। অত্যাধুনিক অভ্যন্তরীণ সড়ক নেটওয়ার্ক সৃষ্টির কারণে মানুষের আর্থ সামজিক উন্নয়ন ঘটেছে। অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, কিছুদিন আগেও বরেন্দ্রের গ্রামের পথে কাদামাটির গন্ধ ছিল। এখন সে গন্ধ পিচঢালা পথে ঢেকে গেছে। নগরের গন্ধ এসে টোকা মেরেছে গ্রামে-হাটবাজারে। এখন গ্রামের অলিগলিও পাকা। রাতের জোনাকী পোকার আলো বিদ্যুতের আলোতে হারিয়ে গেছে। বর্ষাকালে গ্রামের রাস্তার কথা এখন কেবল কল্পনার চোখেই মেলে। শুধু পাকা রাস্তার কারণে গ্রামের মানুষের জীবনযাপনও বদলে গেছে। অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, আমরা মনে করতাম তানোর উপজেলার গৌরাঙ্গপুর নামে একটি গ্রাম আছে- সেটি সবচেয়ে নিভৃত। সে গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রামের মানুষের কোন যোগাযোগ ছিল না। বিচ্ছিন্ন গ্রাম ছিল সেটি। অথচ সেই গ্রামের রাস্তাও এখন পাকা। পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। কেউ কোনদিনও ভাবেনি, এ গ্রামের রাস্তা পাকা হবে, অথচ অবহেলিত ওই গ্রামের মানুষও এখন আর বর্ষাকালে কাদা রাস্তায় হেঁটে হাটে আসে না। ভ্যান, ভুটভুটিতে চেপে চলাচল করে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় দল বেঁধে পাকা রাস্তা বেয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু তানোর নয়, সব উপজেলার গ্রামে গ্রামে দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার। শুধু রাস্তার কারণে এ পরিবর্তন। আর এতে জেগে উঠেছে গ্রামের মানুষ। গ্রামেও এখন উন্নত জীবনযাপন অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রসার ঘটেছে। এমপি আয়েন উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এখন উন্নয়নের ছোঁয়া। দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে চিরচেনা গ্রাম। গ্রাম-বাংলার যে ছবি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, আসলে সে অবস্থা আর নেই। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাকা হয়েছে। তিনি বলেন, যে গ্রামে এক সময় পাখির ডাকে ঘুম ভেঙ্গেছে, এখন সেখানে ঘুম ভাঙ্গে ভারি যানবাহনের বিকট শব্দে। গ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, হচ্ছে। গ্রামীণ জীবনযাপন, গ্রামীণ অর্থনীতি সব কিছুর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে অবিশ্বাস্যরকম। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বলেন, গত পাঁচ বছর রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় তারা ২২শ’ কিলোমিটারের বেশি কাঁচারাস্তা পাকা করেছেন। -মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×