ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাঠে নামছে ভারতের ওলা ও দুবাইয়ের কারিম ॥ আরও তিনটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাজ শুরুর অপেক্ষায়

এ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবার উপযোগী ২৬ লাখ যানবাহন

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৫ জুলাই ২০১৭

এ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবার উপযোগী ২৬ লাখ যানবাহন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইনভিত্তিক পরিবহন সেবা। এখন যেন অনেকটা হাতের মুঠোয় গণপরিবহন। তবে এই সেবা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকারী নীতিমালায় তা দেশজুড়ে উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এদিকে সারাদেশে প্রায় ২৬ লাখ নিবন্ধিত যানবাহন এ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবা দেয়ার উপযোগী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন সঙ্কট সমাধানে এই কার্যক্রমের প্রসার ঘটানোর বিকল্প নেই। আরও দুটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে পরিবহন সেবা চালু করতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের মধ্যেই তারা মাঠে নামবে। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় আরও বেশ কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান চালু করতে যাচ্ছে মোটরসাইকেল ও ট্যাক্সি সেবা কার্যক্রম। এ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবা বৈধতা দিতে সেপ্টেম্বরের মধ্যে নীতিমালা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। নীতিমালা জনবান্ধব করতে ইতোমধ্যে অনলাইনে মতামত নেয়ার কাজ শেষ হয়েছে। এ পর্যন্ত অনলাইনে ১৬৯ জন মতামত দিয়েছেন। বেশিরভাগ মতামতই এসেছে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া ও জনস্বার্থের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত করার বিষয়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে মতামত নেয়ার কথাও জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। জানা গেছে, স্মার্টফোন এ্যাপ্লিকেশননির্ভর ট্যাক্সি সার্ভিস নিয়ে উবারের মতো বাংলাদেশে আসছে ভারতের ‘ওলা’ ও দুবাইভিত্তিক ‘কারিম’। ইতোমধ্যে এ দেশে মার্কেট পর্যালোচনা শুরু করছে তারা। দেশীয় কয়েকটি কোম্পানিও নছে রাইড শেয়ারিং এ্যাপস নিয়ে। রাজধানী ঢাকায় এ্যাপস ব্যবহার করে মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং করছে স্যাম, পাঠাও, বাই-কারস আমার রাইড, ঢাকা মটো ও ইয়েস বাইক। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ইচ্ছেমতো ভাড়া নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে উবারের বিরুদ্ধে। তবে বিআরটিএর খসড়া নীতিমালায় এ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবায় ভাড়া নির্ধারণের কথা উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে, প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি বিবেচনার কথা। কিন্তু ব্যবহারকারীরা বলছেন, ভাড়া নির্ধারণ একটি জরুরী বিষয়। তাহলে ইচ্ছেমতো কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে ভাড়া নিতে পারবে না। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে অনলাইনে নীতিমালার বিষয়ে মতামত গ্রহণ শেষ হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় অনুমোদিত হবে নীতিমালা। এদিকে অনলাইনভিত্তিক পরিবহন সেবা জনপ্রিয় হওয়ায় ওলা আসতে চাচ্ছে শীঘ্রই। থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় গ্রেব বলছে, তারাও আসবে। তবে ট্যাক্সি সার্ভিসে নামতে এখনও দেশী কোম্পানিগুলোর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। আগামী মাস থেকে নামছে মোবাইল এ্যাপস ইজিয়ার। গাড়ি, বাইক কিংবা এ্যাম্বুলেন্স অন ডিমান্ড বুক করা যাবে এ এ্যাপস থেকে। আরেকটি দেশী কোম্পানি টপ আই আই মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও রেন্ট-এ-কারের সকল গাড়ির সমন্বয়ে নামাচ্ছে ‘হ্যালো’। দেশী কুরিয়ার সার্ভিস লজিস্টিকও আসতে চাচ্ছে বাইক-ট্যাক্সি সার্ভিস নিয়ে। দেশে প্রথম মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার ধারণা নিয়ে গত বছর যাত্রা শুরু করে শেয়ার এ মোটরসাইকেল (স্যাম)। তারপরই ট্যাক্সি সার্ভিস নিয়ে নামে উবার। এরপর নামে পাঠাও। যানজটের শহর ঢাকায় এসব সেবা দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে ১৩ জুলাই পর্যন্ত অনলাইনে প্রথম পর্বের মতামত নেয়া হয়েছে। নতুন এই পরিবহন সেবার নাম দেয়া হয়েছে ‘রাইডশেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭’। মোটর কার, জিপ, মাইক্রোবাস, অটোরিক্সা, এ্যাম্বুলেন্স ও মোটরসাইকেল এই পাঁচ ধরনের যান সেবা দিতে পারবে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় অংশীজন ও অন্য মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে খসড়াটি অনুমোদন করলে তা সারাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে। সূত্র বলেছে, বিআরটিএর খসড়া এই নীতিমালা ২৪ জুন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ এন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, বিআরটিএর খসড়া নীতিমালা আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি। সাধারণ মানুষের মতামতের জন্য নীতিমালাটি ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করা হয়েছে। সবাই দেখছেন। মতামত দিয়েছেন। আমরা এক মাস সকলের মতামত নেব। সেপ্টেম্বরে নীতিমালা চূড়ান্ত করার কথা জানান তিনি। বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩০ লাখের কিছু বেশি। রাজধানী ঢাকায় ১১ লাখ। এর অর্ধেকের বেশি মোটরসাইকেল। আর রাইডশেয়ারিং সার্ভিস হিসেবে পরিচালনা করা যাবে এমন যান ৮৬ শতাংশ। এই হিসেবে ২৫ লাখ ৮০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহন এ্যাপসভিত্তিক সেবা দেয়ার উপযোগী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাইভেটকার, জিপ, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেলের মতো ছোট ছোট মোটরযানের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে দেশের সড়ক-মহাসড়ক ও নগরীতে যানজটের সৃষ্টি হয়। তদুপরি মহানগরীতে যাত্রী চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় স্বাভাবিক যাত্রীসেবা ব্যাহত হয়। বিশ্বের বহু দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক সফটওয়্যার এপ্লিকেশনের মাধ্যমে রাইডশেয়ারিং সার্ভিস চালু করে ব্যক্তিগত গাড়ি হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, রাইডশেয়ারিং সেবায় চালককে সব আইন মেনে চলতে হবে। স্বল্প দূরত্বেও যেতে হবে। যাত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে। মোটরযানের যাবতীয় হালনাগাদ দলিল এবং চালকের লাইসেন্স থাকতে হবে। নীতিমালার কোন শর্ত লঙ্ঘন হলে রাইডশেয়ারিং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনের মালিকের সনদ বাতিল এবং দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। নীতিমালার আইনানুগ বিষয়ে আরও রয়েছে, গাইড লাইনের এক বা একাধিক শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন রাইডশেয়ারিং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট বাতিল ও রাইডশেয়ারিং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করাসহ তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অন্যান্য পরিবহনের মতো এ্যাপসভিত্তিক পরিবহন সেবায় সরকারীভাবে ভাড়া নির্ধারণ করার দাবি জানিয়ে নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া না হলে প্রতিষ্ঠানগুলো সারাদেশে ভাড়া নৈরাজ্য চালাবে। সাধারণ যাত্রীদের পকেট থেকে টাকা কেটে নেয়া হলেও কারও কিছুই করার থাকবে না। তিনি যাত্রীবান্ধব নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছে। উবারসহ এ্যাপভিত্তিক সেবা সম্প্রসারণ হলে গণপরিবহনে সুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়বে। ইতোমধ্যে অটোরিক্সা চালক-মালিকদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। তবে নীতিমালাটা হতে হবে যাত্রীবান্ধব। এসব সেবাও যাতে ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজিচালিত অটোরিক্সার মতো না হয়ে যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত মোটরযানকে ভাড়ায় চালানোর বিষয়ে দেশে কোন বিধি-বিধান না থাকায় মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ধারা-৫৩-এর ক্ষমতাবলে পরীক্ষামূলকভাবে রাইডশেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করা হচ্ছে। নীতিমালায় সেবা পরিচালনার শর্তে বলা হয়েছে, এই সেবা চালু করার আগে রাইডশেয়ারিং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ যারা এ্যাপস তৈরি করবে এবং যানবাহনের মালিককে বিআরটিএ থেকে সনদ নিতে হবে। এরপর রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠান, গাড়ির মালিক ও চালকের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চূক্তি সই করতে হবে। খসড়া অনুসারে, এ ধরনের সেবা চালু করতে হলে অবশ্যই কমপক্ষে ২০০ গাড়ির একটি ফ্লিট থাকতে হবে। কোম্পানিকে টিআইএন সনদধারী হতে হবে। ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি হলে একজন একটি এবং ভাড়ায় চালিত হিসেবে নিবন্ধন নেয়া গাড়ি হলে একাধিক এই সেবায় দেয়া যাবে। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি নিবন্ধনের কমপক্ষে এক বছর পর এই সেবায় নিয়োগ করা যাবে। হালনাগাদ রুট পারমিট না থাকলে কোন গাড়ি সেবা দিতে পারবে না। তৃতীয় অনুচ্ছেদে ১১টি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। বিআরটিএর একজন পরিচালক বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ট্যাক্সিক্যাব এবং সিএনজিচালিত অটোরিক্সা খাতে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। শুরুতেই অনিয়ম, চাহিদার তুলনায় সংখ্যায় কম হওয়া এবং আইনের প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে অটোরিক্সায় দৌরাত্ম্য চলছে। এছাড়া বাস-মিনিবাসে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ নৈমিত্তিক। সিটিং সার্ভিসের নামে চলছে নৈরাজ্য। নীতিমালার পর এ্যাপভিত্তিক সেবা বাড়লে গণপরিবহনে অনেক বিকল্প হবে এবং প্রতিযোগিতা বাড়বে।
×