ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সশস্ত্র ক্যাডার সাড়ে তিন শ’

আল ইয়াকিন জঙ্গীরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সংগঠিত করছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৫ জুলাই ২০১৭

আল ইয়াকিন জঙ্গীরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সংগঠিত করছে

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্র সংগঠন আল ইয়াকিন জঙ্গীরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সংগঠিত করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আল ইয়াকিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গী উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী ও টেকনাফের নতুন রোহিঙ্গা বস্তির কুখ্যাত রোহিঙ্গাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে জানা গেছে। এদের দলপতি মৌলভি শফিককে (পলাতক আসামি) ধরতে হন্যে হয়ে খুঁজছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। আল ইয়াকিনের অস্ত্র ও অর্থ যোগানদাতা ভয়ঙ্কর জঙ্গী মৌলভি শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে বেআইনী কর্মকা-ের কারণে উখিয়ার বালুখালী নতুন রোহিঙ্গা বস্তি অপরাধী চক্রের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সেখানে দিনদিন সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন অপকর্ম। এতে জনমনে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। জানা যায়, উখিয়ার পাহাড়ী বনাঞ্চলে দুষ্কৃতকারী রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণে জনমনে অজানা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প ও অনিবন্ধিত (টালের) অস্ত্রধারী কিছু রোহিঙ্গা উখিয়ার তেলিপাড়া টিভি রিলে কেন্দ্রসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যার পর পাহাড়ে এক স্থানে মিলিত হচ্ছে বালুখালী বস্তির আল ইয়াকিন ক্যাডারদের সঙ্গে। এসব দুষ্কৃতকারী রোহিঙ্গাকে তেলিপাড়া জনবসতি এলাকায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করতেও দেখেছে স্থানীয়রা। চিহ্নিত কতিপয় দুর্বৃত্ত ও স্থানীয় মেম্বার অর্থের লোভে তাদের সহযোগিতা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯২ সালে কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা নেতা ডাক্তার জাফর আলম প্রকাশ ডিপো জাফর জানান, মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরএসওর নেতাকর্মীরা তখন থেকে ক্যাম্পে অবস্থান করলেও খুন, গুম, অপহরণের মতো অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটেনি। ইদানীং আল ইয়াকিন সংগঠনের আবির্ভাব হওয়ায় দুটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ওরা এক অপর পক্ষকে ঘায়েল করতে সমর্থক নেতাকর্মীদের অপহরণ করে হত্যা করছে। ১৩ জুন রাতে আল ইয়াকিনের সন্ত্রাসীরা কুতুপালং ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আইয়ুব মাঝি (৪৫) ও মোহাম্মদ সেলিমকে (২৮) অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে হত্যা করে তেলিপাড়া খালে ভাসিয়ে দিয়েছে। ২৯ জুন কুতুপালং বস্তি পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিককে হত্যার উদ্দেশে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। এক মাসের ব্যবধানে চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যাকা-, অপহরণ, আল ইয়াকিনের জন্য চাঁদার দাবিতে সাধারণ রোহিঙ্গা নির্যাতন ও ছুরিকাঘাতের ঘটনায় ক্যাম্প-বস্তিতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা শীঘ্রই সকল রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ায় অথবা অন্য কোন স্থানে স্থানান্তর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছে। তারা জানায়, এটি দ্রুত করা হলে সেখানে আল ইয়াকিন ও আরএসও ক্যাডাররা কোনভাবেই যাবে না। এতে সাধারণ রোহিঙ্গারা শান্তিতে শরণার্থী জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা বক্তেয়ার আহমদ জনকণ্ঠকে জানান, কুতুপালং বস্তিতে আরএসও, আল ইয়াকিনের সশস্ত্র সদস্যরা চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। এসব অপরাধ দমনে সহযোগিতা করতে গিয়ে তাকেও মৃত্যুর হুমকি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এদিকে রোহিঙ্গা বস্তিতে চলমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উদ্যোগী হয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা নেতাদের নিয়ে বৃহস্পতিবার তার অফিস কক্ষে বৈঠকে বসেন। এ সময় রোহিঙ্গা নেতা শাহ আলম, মোহাম্মদ নুর, আবু ছিদ্দিক, আলী আহমদ, আবদুর রহিম অভিযোগ করে জানান, আল ইয়াকিন নামধারী সংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে রোহিঙ্গারা আতঙ্কে দিনযাপন করছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব নুর মোহাম্মদ সিকদার জানান, টেকনাফ, কুতুপালং ও বালুখালীতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নির্ধারিত একটি স্থানে গ-ির ভেতরে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রাখা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হতে পারে। কুতুপালং বস্তির সেক্রেটারি মোহাম্মদ নুর জানান, উখিয়া-টেকনাফে আল ইয়াকিনের প্রায় সাড়ে ৩ শতাধিক সদস্য রয়েছে। যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে অপরাধ প্রবণতা চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা নেতা ডাক্তার ফয়সাল আনোয়ার জানান, রোহিঙ্গাদের অতি দ্রুত স্থানান্তর করে প্রশাসনের কড়া নজরদারিতে রাখা না হলে ভবিষ্যতে আল ইয়াকিন সদস্যরা আরও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে। রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন বলেন, মানবিক বিপর্যয়ের কারণে সরকার মানবতার পরিচয় দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। অন্যত্র পুনর্বাসনের আগে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট একটি গ-ির ভেতরে রাখার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এ জন্য ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে বুধবার অনুষ্ঠিত সভায় পুলিশ সুপার ড. একে এম ইকবাল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ শামছুদ্দৌজা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় বক্তারা বলেন, পার্শ¦বর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সরকার মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। কয়েকটি এনজিওর সমন্বয়ে তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। এদের অন্যত্র পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াও চলছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়াসহ সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে উভয় দেশের সরকার কাজ করছে। সূত্র জানায়, মিয়ানমার সীমান্ত থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে বালুখালী বনাঞ্চলে বস্তি গড়ে ওঠায় এটি আল ইয়াকিন জঙ্গীদের জন্য বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কেননা তারা সীমান্তে টহল দল বিজিবিকে পাহারা ও ছোট নদীটি পার হয়ে মিয়ানমারে আল ইয়াকিন জঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ফের ফিরে আসছে বালুখালী বস্তিতে। আরাকান বিদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন আল ইয়াকিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গীরা বালুখালী নতুন বস্তিতে ছদ্মবেশে আস্তানা গেড়েছে। তবে তাদের ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। আল ইয়াকিন ক্যাডাররা তাদের নিরাপদ আস্তানা তৈরির লক্ষ্যে বালুখালীর গুটিকয়েক ব্যক্তিকে টাকার বিনিময়ে বশে রেখে বন বিভাগের জায়গা দখল করে নতুন বস্তি গড়ে তুলেছে। মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আরও নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে বালুখালী বস্তিতে।
×