ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানবপাচার চক্রের প্রতারণা

জর্দানের কারাগারে শত শত নারীর দুঃসহ বন্দী জীবন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৫ জুলাই ২০১৭

জর্দানের কারাগারে শত শত নারীর দুঃসহ বন্দী জীবন

আজাদ সুলায়মান ॥ দুই বছর ধরে জর্দানের কারাগারে আটক কেরানীগঞ্জের গৃহবধূ মালা। অভাবী সংসারের দুঃখ ঘোচাতে তিনটি শিশু সন্তান ফেলে তিনি মানবপাচারকারীর প্রলোভনে দেশ ছাড়েন। দালালের খপ্পরে পড়ে ধারকর্জ করে জর্দান গিয়ে বুঝতে পারলেনÑ তিনি কত বড় প্রতারণার শিকার হয়েছেন। চার বছরের প্রবাস জীবনের দুই বছরই কাটছে কারাগারে। এখন তিনি আর দেশে ফিরতে পারছেন না। তার স্বামী প্রতিদিন ধর্ণা দিচ্ছেনÑ মতিঝিলের আদম অফিসে। তারা তার কোন কথাই শুনছে না। উল্টো হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয় মানবপাচারকারীরা। তার চেয়েও করুণ অবস্থা কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের হাজেরা ও অনজনা, ভৈরবের শিউলি, কুলাউড়ার মালার। তারাও জর্দান গিয়ে শুধু প্রতারণারই শিকার হননি, জীবনের সর্বস্ব হারাতে হয়েছে। তাদের মতো এমন ৩০০ নারী এখন জর্দানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে মরছে। তারা দেশে ফিরতে পারছে না। তাদের পরিবার থেকে বলা হচ্ছে শুধু একটি টিকেটের জন্য তারা দেশে ফিরতে পারছে না। প্রতিদিনই জর্দানের কারাগারের চার দেয়ালের বন্দীজীবনে তারা কিভাবে দেশে ফেরার আকুতি-মিনতি কান্নাকাটি করছে তা ফোনে শোনানো হয় স্বজনদের। কিন্তু ফিরিয়ে আনার উপায় নেই। আর যারা এই অপরাধে জড়িত তারা নিজেদের পরিচয় দেয় জনশক্তি রফতানিকারক হিসেবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভাষায়, তারা মানবপাচারকারী, তারা মানবতার চরম শত্রু। মানুষ হয়ে মানুষকে পণ্য করেই তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। মতিঝিল, পল্টন, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ ফার্মগেট এলাকায় অফিস নিয়ে এই সংঘবদ্ধ চক্র যুগের পর যুগ মানবপাচার করে আসছে। তাদের অফিসে মাঝে মাঝে র‌্যাব পুলিশ হানা দিলেও আবারও জামিনে এসে শুরু করে একই অপরাধ। দেশে-বিদেশে কয়েকজন মহিলা দালাল চক্রের মাধ্যমেই মূলত বিদেশে চাকরির নামে এ ধরনের নারী পাচারের ঘটনা ঘটছে। প্রতারিতদের দুঃখ-দুর্দশার বিষয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, দেশের একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী কিভাবে জনশক্তি রফতানির নামে নারী পাচার করছে। খালেদা নিজেই শোনালেন সেই দুঃসহ জীবনের করুণ কাহিনী। ভিনদেশের কারাবাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই তাকে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। কী অপরাধ ছিল আজও জানতে পারেননি। জীবন বাঁচাতে সব ফেলেই ফিরতে হয়েছে দেশে। কিশোরগঞ্জের এই হতভাগী খালেদা এখন হিসাব মেলাচ্ছেন আর নিজেকেই প্রশ্ন করছেন, কত টাকায় জর্দান গেলাম, কতদিন কাজ করলাম, কত টাকা পেলাম, কতদিন জেল খাটলাম, কতদিন নির্যাতনের শিকার হলাম। এসব প্র্রশ্নের জবাব মেলাতে পারছেন না। শুধু দুষছেন আদম পাচারকারী সেই প্রতারক খোকনকে। নিজের ভাগ্যকেও খানিকটা দায়ী করলেন, ‘দুধের বাচ্চাকে ফেলে রেখে জর্দান গেলাম। ফিরলাম এক কাপড়ে। এই বিচার কার কাছে দেব। কে করবে বিচার? শুধু তিনি একা নন। তবুও তিনি এতুটুকু সান্ত¡না পান এই ভেবে যে তিনি দেশে ফিরতে পেরেছেন। মালার আর্তনাদ ফিরিয়ে নাও দেশে শত অভাব-অনটনের মাঝেও মালার ছিল সুখের সংসার। কাঠমিস্ত্রি স্বামীর আয়ের পাশাপাশি নিজে গার্মেন্টসে কাজ করতেন। দুইজনের আয়ে বেশ ভালই চলছিল সংসার। এরই মাঝে পিছু নেয় সাত্তার নামের এক দালাল। সে তাকে স্বপ্ন দেখায় বিদেশ অল্প খরচে নারীদের চাকরি পাওয়া যায়। বেশি নয় মাত্র হাজার বিশেক টাকা খরচ করলেই যাওয়া যায়। সংসারের তিন সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় মালা তাতে রাজি হন। তিনি নিজের বেতন জমানোর পাশাপাশি কিছু ধারকর্জ করে দালালের কাছে দেন। স্বামীর অজান্তেই সব করেন। সাত্তার মালাকে নিয়ে যান ১১৫/২৩ মতিঝিল সার্কুলার রোডে শান ওভারসীজের অফিসে। এখানকার মালিক সামসুল আলম কাজলের সঙ্গে দালাল সাত্তার পরিচয় করিয়ে দেন মালাকে। তাকে আশ্বস্ত করা হয়, জর্দানে বাংলাদেশী মেয়েদের খুব চাহিদা। অল্প পরিশ্রম করলেই চলে, বেতন ভাল। মাসিক কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া ফ্রি। বছরের পর বছর ধরে কাজ করার সুযোগ। বছরে একবার ছুটি। দেশে আসা-যাওয়ার ছুটি ভাল। কাজলের মুখে এমন স্বপ্নসুখের আশ্বাসে পুলকিত হন মালা। তিনি বাসায় গিয়ে সব টাকা যোগাড় করে আবার আসেন। সাত্তারের মাধ্যমে কাজলকে পরিশোধ করেন। তার কয়েক মাসের মধ্যেই ভিসা আসে। যথারীতি ফ্লাইটও দেয়া হয় ১৩ সেপ্টেম্বর। মালাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় জর্দান। পেছনে তার তিন কন্যা ও স্বামীর উদ্বাস্তু সংসার। একবুক স্বপ্ন নিয়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে ফ্লাইটে উঠলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি সব ভুলে যান। তিনি জানেন, সুখের জন্য এতটুকু ত্যাগ না হয় করতেই হয়। কিন্তু মালা তখনও জানেন না কি এক অন্ধকার দুঃসহ জীবনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন তিনি। জর্ডানের আম্মান বিমানবন্দরে নামতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দূরবর্তী এক শহরে। একজন ব্যবসায়ীর বাসায় তাকে গৃহপরিচারিকার কাজে লাগানো হয়। বেতন মাসিক ১৩ হাজার বাংলাদেশী টাকা। ওখানেই থাকা-খাওয়া ফ্রি। কাজ রান্নাবান্না ঘর মুছা, টয়লেট পরিষ্কার করা, মেশিনে কাপড় কাচা, বাসার উঠানের বাগানের পানি দেয়া, ম্যাডামের হুট ফরমায়েস করা, রাতে কিচেনের পাশে একটা রুমে ঘুমানো। অনেক কষ্টের কাজ। তাতেও আপত্তি নেই। জেনেই এসেছেন তিনি। রাতে তাকে শুতে দেয়া হয় রান্নাঘরের পাশে। পরদিন তাকে আরও কিছু কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়। সাহেবের শরীর মাঝে মাঝে খারাপ হয়Ñ তখন তাকে সেবা দিতে হবে। শরীর মালিশ করতে হবে। মালার মনে খটকা লাগে। তবুও চাকরির স্বার্থে রাজি হন। দ্বিতীয় দিন থেকেই এ সেবা চলতে থাকে। তারপর কি? জানতে চাইলে মালার স্বামী হেলাল খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমি মুখ দিয়ে কিভাবে বলি? স্বামী হয়ে সে কথা বলাটাও তো পাপ। কি না করত? ওই বাসায় বাপবেটা কি না করেছে? আমার স্ত্রীকে শারীরিক মানসিক পাশবিক যা যা করার সব ধরনের নির্যাতনই করেছে। পুরো একটা বছর বলতে গেলে ওই বাসায় তাকে বন্দীজীবন কাটাতে হয়েছে। সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েও তো তার কপালে দু’বেলা ভাত জুটত না। ওরা যা খায় তার উচ্ছিষ্ট খাবার যেমন, যব রুটি সালাদ ও খবুজ দেয়া হতো। যা মালা কিছুতেই মুখে দিতে পারত না। সপ্তাহে একদিন বাসায় ভাত পাকানো হতো। সেদিনই পেট ভরে ডাল দিয়ে খেতে পারত। আর বাকি দিনগুলো শুধু শুকনো রুটি আর সামান্য ডাল, সবজি খেয়ে থাকত হতো। হেলাল জানান, অত্যাচার সইতে না পেরে একদিন প্রতিবেশী অপর এক বাংলাদেশী নারীর সাহায্যে ওই বাসা থেকে পালিয়ে আসে মালা। পাসপোর্ট সেখানে ফেলেই তাকে চলে আসতে হয়। এবার আশ্রয় নেয় শাবানা নামের অপর এক বাংলাদেশী মহিলার কাছ্।ে তার কাছে থাকাবস্থায় মালাকে অপর এক বাসায় ছুটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কদিন এভাবে কাজ করার পর তাকে অপর বাসায় বদলি করা হয়। আজ এ বাসায় কাল ও বাসায় কাজ করতে হয়। এভাবে কাটে এক বছর। এ সময় শাবানাও তাকে এক বাসায় রেখে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করে। দুই বছরের মাথায় শাবানা আস্তানা থেকে পালিয়ে যান তিনি। পাসপোর্ট না থাকায় তিনি পুলিশের কাছে স্যারেন্ডার করলে তাকে দেয়া হয় আম্মানের জোয়াইদ নামক এলাকার একটা জেলে। আজ পর্যন্ত তিনি সেই জেলেই। জেল থেকে প্রতি মাসে একবার স্বামীর সঙ্গে এক মিনিট কথা বলার সুযোগ পান। এই এক মিনিটেই তিনি বার বার জানতে চান, কবে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে তাকে। বাচ্চা তিনটে কেমন আছে। প্রতারক আদম ব্যাপারীর নাম পত্রিকায় দিয়ে শাস্তি দেয়ারও অনুরোধ করেন স্বামীকে। হতভাগা স্বামী তখনই ছুটে যান শান ওভারসীজের কাছে। সেখানে গিয়ে বার বার একই আকুতি-মিনতি, ‘বেতন, কাজ আর টাকাপয়সা ক্ষতিপূরণ কিছুই চাই না, ফিরিয়ে দাও আমার স্ত্রীকে। তার এ আর্তনাদে কারোর মন গলে না। কেউ শোনে না তার দুঃখের কাহিনী। সবারই যেন বধির কান। বার বার ধর্ণা দিচ্ছেন তিনি শান ওভারসীজের অফিসে। তাকে উল্টো আরও দোষ দেয়া হয়, এটা নাকি তার কপাল দোষ। কপালে থাকলে মালা আসবে। হেলাল খানকে ভাগ্যের ওপর ভরসা রাখার সান্ত¡না দিয়ে তাড়ানো হয় প্রতিবারই। থানা পুলিশও করারও সাহস নেই। চারটি বছর ধরে তিনি এদিক-সেদিক ছুটেন। কখনও আদম অফিসে, কখনও মালার সঙ্গে জর্দানের জেল খাটা অপর বাংলাদেশী নারীদের বাড়িতে গিয়ে ধর্ণা দেন। এ অবস্থায় হঠাৎ মাস খানেক আগে তিনি জানতে পারেন ওই জোয়াইদ কারাগার থেকে দেশে ফিরে এসেছেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার গৃহবধূ খালেদা। হেলাল ছুটে যান তার কাছে, জানতে চান তিনি কিভাবে দেশে ফিরেছেন, কিভাবে সেই জেলে মালার সঙ্গে ছিলেন। খালেদার কাছ থেকে জোয়াইদ কারাগারে আটক শত শত বাংলাদেশী নারীর করুণ কাহিনী শোনেন। মালাকে ফিরিয়ে আনার উপায় কি? খালেদা জানালেন তার জীবনের ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের কথা। কি নির্যাতনই না সইতে হয়েছে তাকে। ১৬ মাসের জর্দান জীবনের ৭ মাসই তাকে থাকতে হয়েছে জোয়াইদ কারাগারে। শেষ পর্যন্ত তিনি এ প্রতিনিধির সহযোগিতায় জর্দান থেকে গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে ফেরেন। খালেদার বাড়িতে বসেই এ প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সরাসরি ছুটে আসেন জনকণ্ঠের অফিসে। এখানেও তার একই আবদার, আমি আর পারছি না। তিন শিশু সন্তান নিয়ে কঠিন বিপদে পড়েছি। ওদের সারাক্ষণ ঘরে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। আমি ছাড়া তিন সন্তান দেখার কেউ নেই। সারাক্ষণ ঘরে থাকতে হয়। কাজ করার উপায় নেই। এখন অবস্থায় হয়েছেÑ না খেয়ে মরার। চোখেমুখে অন্ধকার দেখি। হেলাল জানালেন, তার সুখের সংসার তছনছ হওয়ার কাহিনী। কুলাউড়ার পশ্চিমপাড়ায় তার বাড়ি। গরিবের ঘরে জন্ম। নিজের জমি নেই। এক সময় অন্যের জমি চাষ করতেন। বাবা-মা নেই। তবুও সংসারযাত্রা। বিয়ে করেন মালা বেগমকে। কিছুদিন বাড়িতেই ঘর-সংসার করার পর ভাগ্যোন্বেষণে চলে আসেন কেরানীগঞ্জে। এখানে তিনি কাজ নেন একটি ফার্নিচারের দোকানে। আসবাবপত্র তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ শুরু করেন। মালা বেগমও কাজ নেন গার্মেন্টসে। কর্মজীবী এই দম্পতির আয়ে সংসার চলছিল বেশ। এরই মাঝে তিন তিনটে সন্তান আসে সংসারে। তারা এখনও শিশু বলাই চলে, ঝুমু (১৪), সিয়াম (৯) ও জামিলা (৮)। তিনজনেই বিদ্যার্থী। স্থানীয় একটি স্কুলেই চলে লেখাপড়া। এদের নিয়ে চরম শান্তিতেই ছিলেন বলে এখন শুধুই আফসোস করেন হেলাল ‘কি বলব ভাই? এদের দুবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারতাম। বাসা ভাড়া মিটিয়ে স্কুলের খরচ দিয়ে বাজার সওদা করে যেভাবে চলতাম, তাতে অনেক সুখ ছিল। আমরা দুজন সারা দিন পরিশ্রম করে রাতে বাচ্চাদের নিয়ে খুব মজা করতাম। মাঝে মাঝে বাইরে যেতাম। কিন্তু এতটুকু সুখও যে আমার সইলোনা। হঠাৎ একদিন মালার কাছে শুনি সে বিদেশ যাবে-জর্দান। ভাল বেতন, এই হাজার পনের টাকা। বাসাবাড়ির কাজ। কয়েক বছর থাকতে পারলে অন্তত বাচ্চাদের ভবিষ্যতটা ভাল যাবে। আমার বাধা দেয়ার উপায় কি? বাচ্চা তিনটার কথা চিন্তুা করেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজি হতে হয়। কিন্তু..। একশ্বাসে এতটুকু বলার পর শ্বাসরুদ্ব হয়ে আসে হেলালের। তারপর জানালেন শোনালেন প্রতারণার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এন্তার কাহিনী। ছাত্তার নামের এক দালাল ছিল মহল্লায়। সে সুযোগ পেলেই মালার কাছে বসে গুনগুন করত। ইনিয়ে বিনিয়ে বলত, জর্দানের স্বপ্নকথা। মাত্র হাজার পঁচিশেক টাকা খরচ যাবে। তাতেই জীবন যাবে পাল্টে। গার্মেন্টসে এত পরিশ্রমের মানে কি? ছাত্তারের কথায় পটে যান মালা। তিনি একাই নিজের সঞ্চয় ও ধারকর্জ করে যোগাড় করে দেন এ টাকা। ছাত্তার তাকে নিয়ে যায় শান ওভারসীজে। মাস তিনেকের মাঝেই সুখের সংসার ফেলে দেশ ছাড়েন আরও সুখের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে। তারপর কী হলো? সে কথা বলতে গিয়েই লজ্জায় চুপসে যান লাজুক স্বভাবের হেলাল, ‘সে কথা বলার মতো নয়। স্বামী হয়ে মুখ দিয়ে কিভাবে বলি স্ত্রীর ওপর অন্যের নির্যাতনের কথা? ভিসায় লেখা রয়েছে, জর্দানের আম্মানে সিডাল কোম্পানির মাধ্যমে জাবাল আল হোসানের ঠিকানা। ওই অফিসের ফোন নম্বর ৭৯৬৯৭১৭৬৪, বাসার ঠিকানা বিল্ডিং নং ৬/বি, স্ট্রিট আবু ওবায়দা আর গার, অফিসের ফোন ০৬৫৫৩৯৯৫৮। এ দুটি ঠিকানাই লেখা রয়েছে ভিসায়। ওই গৃহকর্তার ১ ছেলে ২ মেয়ে, তার ফোন নম্বর হচ্ছেÑ ০০৯৬২৭৯৬৯৭১৭৬৪। বাসার সব কাজ-রান্নাবান্না, ঘর মোছা, উঠান ঝাড়ু দেয়া, গাড়ির গ্যারেজ পরিষ্কার করা, হেন কোন কাজ নেই। রাতে ক’ঘণ্টা ঘুমানো ছাড়া বিশ্রামের কোন সুযোগ ছিল না। এভাবে কদিন কাজ করার শুরু হয় নির্যাতন। ঠিকমতো খাওয়া দিত না, কিছু খেতে চাইলে মারধর চলত, রাতেও চলত নির্যাতন। মালা সে কথা নিজের মুখে ফোন করে আমাকে বলত। বিশ্বাস করতাম না। অত্যাচার নির্যাতন সইতে না পেরে মালা ওই বাসা থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। ওই এক বছরে মাত্র ৭ মাস বেতন পায় সে। হেলাল স্বীকার করেন, ওই বাসা থেকে অন্য এক বাসায় কাজ নেন মালা। সেখানে কিছুদিন থাকার পরও কপালে সুখ জোটনি। ওখানেও গৃহকর্তার ছোবল। আবারও বাসা বদল। এবার শাবানা নামে নোয়াখালীর এক নারীর সঙ্গে দেখা। তিনি তাকে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ছুটা কাজ করার সুযোগ দেন। তাতেও মেলেনি নিস্তার। সবখানেই আঘাত আসে সম্ভ্রমের ওপর। শেষটায় আলেয়া নামের অপর এক বাংলাদেশী নারীর পাল্লায় পড়েন। তিনি মালাকে বিপদ থেকে উদ্ধারের আশ্বাস দেন। তাতেও কাজ হয়ন্।ি এমন সময় আসে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। প্রথম বাসার মালিক তার বিরুদ্ধে বিনানুমতিতে পালিয়ে আসার অভিযোগে থানায় মামলা কর্ন্।ে পরিণামে গ্রেফতার এবং কারান্তরীণ। এখন তিনি আছেন জোয়াইদ এলাকার একটি কারাগারে। ওই কারাগার বসেই তিনি ০০৯৬২৬৪১২২৮৯৩ নম্বর ফোন থেকে স্বামীর কাছে মাসে একবার ফোন করেন। জর্দানের কারাবিধি অনুযায়ী মাত্র এক মিনিট কথা বলার সুযোগ পান্। ওই এক মিনিটেই তিনি শুধু বলতে পারেন কিভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন মানবপাচারকারীদের কবলে। তিনি শুধু তিনটা সন্তানের মুখ একনজর দেখতে চান। যে করেই হোক দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। জোরে কাঁদলেও সহকারাবন্দীরা আপত্তি তোলেন। এ অবস্থায়ই চলছে গত এক বছর। খালেদা ফিরলেও ঘুরেনি ভাগ্যের চাকা কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার পাটুয়াভাঙ্গা ভিটিপাড়া গ্রামের গৃহবধূ খালেদা। স্বামীর অভাবের সংসার। বিয়ের পর পরই দুটো বাচ্চা আসে সংসারে। একজন আট বছরের সিফাত অপরজন চার বছরের জাকির। বাপ-দাদার ভিটাবাড়ি বিক্রি করে, দুই শিশু বাচ্চার মায়া বিসর্জন দিয়ে, জীবিকার তাগিদে খালেদাকে দেশ ছাড়তে হয়। সেটা আট মাস আগের ঘটনা। এলাকার এক দালালের মাধ্যমে ১৪৫ আওলাদ হোসেন মার্কেটের আরএস লিংকার্স (আরএল নং ৯৬) নামক জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জর্দান যান খালেদা। এজন্য তাকে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করতে হয়। ওই অফিসের মালিক খোকন তাকে মাসিক ১৩ হাজার টাকা বেতনে জর্দান পাঠান। সেখানে এক বাসায় কাজ নেন আয়ার। কিছুদিন কাটে মোটামুটি। টানা ৭ মাস বেতনও পাঠিয়েছেন দেশে। তার পরই নেমে আসে নিরন্তর যন্ত্রণা। অর্ধাহার- অনাহারের শিকার হন। যন্ত্রের মতো কাজ করতে হয় তাকে। কারা দায়ী ? এত বাংলাদেশী নারী জর্দানের কারাগারে থাকলেও সরকারের কোন মহলেরই উদ্যোগ নেই তাদেরকে ফিরিয়ে আনার। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কাছে নাকি এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোন তথ্যই নেই। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, অবশ্যই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×