ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

কেন আমরা মিথ্যা বলি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৫ জুলাই ২০১৭

কেন আমরা মিথ্যা বলি

মিথ্যাচার মানবজাতির ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মিথ্যাচার মানুষের মনোজগতে গভীরভাবে প্রোথিত এক বৈশিষ্ট্য। বেশিরভাগ মানুষই জীবনের কোন না কোন সময় কম-বেশি মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মতো চরিত্র পৌরাণিক কাহিনীতেই সম্ভব, বাস্তবে নয়। জীবনে কখনও একবার মিথ্যা উচ্চারণ করেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। মিথ্যাচার মানবজীবনের অঙ্গ। মিথ্যাচারের অনেক বড় বড় ও ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে নিজের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে চরম মিথ্যাচার করেছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে তার কখনও যৌন সম্পর্ক হয়নি এটা ছিল বিল ক্লিনটনের ডাহা মিথ্যাচার, যা ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনেক মিথ্যাচারও আজ সর্বজনবিদিত। জ্যাকব হল নামে এক আমেরিকান সারাজীবন অসংখ্য মিথ্যা কথা বলার জন্য গত বছর ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে বড় মিথ্যুক খেতাব এবং সেইসঙ্গে একটি সোনালী বেলচা পেয়েছেন। তাঁর মতে মিথ্যা না বললে তার জীবনটা একেবারেই পানসে হয়ে যেত। হলের মতো চরিত্র পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। মিথ্যাচার এমন একটা বিষয় যে ব্যাপারে আমাদের অধিকাংশই বেশ দক্ষ। আমরা স্বচ্ছন্দে ছোট হোক বড় হোক মিথ্যা কথা বলি। অনেক মিথ্যাই অনুপকারী বা অন্যের ক্ষতি করে না বা যার উদ্দেশ্য থাকে অন্যের অনুভূতিকে আঘাত থেকে রক্ষা করা। আবার অনেক মিথ্যা অন্যের, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নিজেরও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সমাজ গবেষকদের মতে, মিথ্যা বলার এই আচরণের উৎপত্তি ভাষার আবির্ভাবের খুব বেশি পরে নয়। কায়িক শক্তি ব্যবহার না করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে উদ্দেশ্য হাসিলের এই ক্ষমতাটা সম্পদ ও সঙ্গী/সঙ্গিনী প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছিল। ক্ষমতা লাভের অন্যান্য উপায়ের তুলনায় মিথ্যাচার এক সহজ কৌশল। অন্যের অর্থ বা সম্পদ বাগানোর জন্য তাকে খুন করার তুলনায় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সে কাজ করা অনেক সহজ। সমাজবিজ্ঞানীরা মিথ্যাচারের স্বরূপ ও শিকড় নির্ণয়ের চেষ্টা করে চলেছেন। বের করার চেষ্টা করছেন আমরা কখন কিভাবে মিথ্যা কথা বলতে শিখি। তাদের মতে, হাঁটা বা কথা বলতে শেখার মতো মিথ্যা বলতে শেখাও শিশুর বিকাশের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং পর্যায়। শিশুরা ২ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যে মিথ্যা বলতে শিখে এবং সর্বাধিক মিথ্যা বলে সেই বয়সে এসে যখন তারা নিজেদের স্বাধীনতা যাচাই করতে চেষ্টা করে। সব শ্রেণীর সব বয়সী, সব পেশার মানুষই মিথ্যাচার করতে পারে। মিথ্যাচারী অনেক রকমের আছেÑ চতুর, ধূর্ত, পাকা, স্বভাবত এবং নিরীহ। সব মিথ্যা আবার এক রকমের নয়। লোকে একটা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেমন সত্য কথা বলে তেমনি মিথ্যাও বলে। টিম লেভিন নামে এক গবেষকের মতে, সততায় যদি কাজ না হয় তাহলে আমরা মিথ্যার আশ্রয় নেই। ব্রুনো ভারশিউয়ার নামে এক মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘সত্য স্বাভাবিকভাবেই আসে। তবে মিথ্যাচারের জন্য চেষ্টা করতে হয় এবং তার জন্য একটা শাণিত মন দরকার। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিজেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ২২ শতাংশ লোক ভুলত্রুটি বা অপকর্মকে ধামাচাপা দিতে মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং ১৪ শতাংশ লোক অন্যদের এড়িয়ে চলে বা অন্যদের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য যেখানে কাজ করে সেখানে ১৬ শতাংশ লোক আর্থিক সুবিধা আদায়ের জন্য এবং ১৫ শতাংশ লোক অর্থবহির্ভূত সুবিধা লাভের জন্য মিথ্যাকে আশ্রয় করে। ৭ শতাংশ লোক কি উদ্দেশ্যে মিথ্যাচার করে তা স্পষ্ট নয়, এমনকি নিজেদের কাছেও নয়। অন্যদের নানাভাবে প্রভাবিত করার জন্য মিথ্যাচার করে ১১ শতাংশ লোক। মজা করা বা অন্যদের হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে ৫ শতাংশ মানুষ। নিজেদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে মিথ্যাচার করে ৮ শতাংশ মানুষ। বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার বা অগ্রাহ্য করার জন্য মিথ্যাচার করে ২ শতাংশ মানুষ। ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কোন্ বয়সের মানুষ কি পরিমাণ মিথ্যা কথা বলে তার এক সমীক্ষা চালিয়েছেন জনৈক গবেষক। তাতে দেখা যায় যে, ৬-৮ বছর বয়সীদের ২৯ শতাংশ ১ থেকে ৫টা মিথ্যা এবং ৭ শতাংশ ৫-এর বেশি মিথ্যা কথা বলে। অন্য বয়সীদের বেলায় এই হিসাবটা ৯-১২ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৪৩ শতাংশ ও ৪ শতাংশ, ১৩-১৭ বছর বয়সীদের যথাক্রমে ৫৯ ও ১৫ শতাংশ, ১৮-৪৪ বছর বয়সীদের যথাক্রমে ৪৫ ও ৯ শতাংশ, ৪৫-৫৯ বছর বয়সীদের যথাক্রমে ৩৯ ও ১১ শতাংশ এবং ৬০-৭৭ বছর বয়সীদের যথাক্রমে ৩৪ ও ১০ শতাংশ। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বেশিরভাগ শিশু উঁকি মেরে দেখার ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে পারে না এবং সেটা করার পর তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলে সে উঁকি মারেনি। এমন শিশুদের কেকতটা করে তা নির্ভর করে তাদের বয়সের ওপর। ২ বছর বয়সের মাত্র ৩০ শতাংশ শিশু এমন মিথ্যাচার করে। ৩ বছর বয়সীদের এই হার ৫ শতাংশ আর ৮ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ শতাংশ। বয়স যত বাড়ে শিশুদের মিথ্যা বলার পারদর্শিতাও ততই বাড়ে। এই পারদর্শিতা বৃদ্ধি আসলে শিশুর ক্ষমতা ও সামর্থ্যরে বিকাশ বলে মন্তব্য করেছেন এক সমাজবিজ্ঞানী। মিথ্যাচার ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে কি কোন সম্পর্ক আছে? মনোবিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে একমত নন। যদিও দেখা গেছে যে, নির্দিষ্ট ধরনের মানসিক বৈকল্যের লোকদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট মিথ্যাচারিতার আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা আছে। সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব বৈকল্যের শিকার বলে চিহ্নিত লোকদের বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার অভ্যাস আছে। অন্যদিকে নার্সিসিস্ট বা আত্মপ্রেমীরা নিজেদের ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে থাকে। অন্যদের চেয়ে বেশি মিথ্যা বলে এমন ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য আছে কি? এ ব্যাপারে ২০০৫ সালে মনস্তাত্ত্বিক ইয়ালিং ইয়াং ও তার দল তিন শ্রেণীর প্রাপ্ত বয়স্কের ব্রেন স্ক্যান তুলনা করে দেখেন। একটি হলো ১২ জনের একটি গ্রুপ যাদের পুনঃপুনঃ মিথ্যা কথা বলার ইতিহাস আছে। দুই, ১৬ জনের একটি গ্রুপ যারা সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব বৈকল্যের শ্রেণীতে পড়ে, তবে পুনঃপুনঃ মিথ্যা বলে না। তৃতীয়, ২১ জনের একটি গ্রুপ যারা সমাজবিরোধীও নয় এবং মিথ্যা বলার অভ্যাসও নেই। ব্রেন স্ক্রানে গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে, মিথ্যাচারীদের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টিস-এ নিউরাল ফাইবারের পরিমাণ অন্ততপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি। এ থেকে বোঝা যায় যে, মিথ্যাচার যাদের অভ্যাস তাদের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে কানেকটিভিটি বেশি। হয়ত এজন্যই তারা মিথ্যাচার করতে আগে থেকে প্রণোদিত হয়। কারণ, তারা অন্যদের থেকে আরও তাৎক্ষণিকভাবে মিথ্যা কথা ভাবতে পারে। কিংবা হতে পারে যে, ব্যাপারটা পৌনপুনিক মিথ্যাচারের ফল। আরেক গবেষণায় ফাংশনাল এমআরআই পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে, যারা মিথ্যাচারী তাদের মস্তিষ্কের নিউক্লিয়াস একুমবেনের সক্রিয়তা বেশি। এটি হচ্ছে মস্তিষ্কের সামনের দিকের একটা কাঠামো যা রিওয়ার্ড প্রসেসিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একান্তই সৎ প্রেক্ষাপটে হলেও অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনায় কারোর রিওয়ার্ড প্রসেসিং ব্যবস্থা যত বেশি উত্তেজিত হলে অন্যের কাছে মিথ্যাচার করা বা তাকে প্রতারিত করার সম্ভাবনা তার তত বেশি হতে পারে’ বলে মন্তব্য করেছেন গবেষক জসুয়া যান। এক মিথ্যাচার আরেক মিথ্যাচারের জন্ম দেয় এবং তা থেকে পরেরটা। মিথ্যা কথা বলার সময় যে স্ট্রিস বা আবেগগত অস্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি হয় তাতে মস্তিষ্ক কিভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠে তা দেখিয়েছেন ট্যালি শ্যারট নামের এক নিউরোবিজ্ঞানী। এই অভ্যস্ত হয়ে উঠার ফলে পরের মিথ্যা কথা বলা সহজতর হয়। তাঁর পরিচালিত সমীক্ষায় অংশ নেয়া লোকদের এফএমআরআই স্ক্যানে এমিদাডালা নামে মস্তিষ্কের একটি অঞ্চলের ওপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করা হয়। এই অংশটি আবেগ অনুভূতি প্রক্রিয়া করার কাজে যুক্ত। গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে, প্রতিটি মিথ্যাচারের সঙ্গে সঙ্গে এমিগডালার প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। গবেষকরা দেখিয়েছেন আমাদের বিশেষ প্রবণতাই হলো সেসব মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নেয়া যা আমাদের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলে। এমনকি সুস্পষ্ট প্রমাণের দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে খ-িত হওয়ার পরও কিছু মিথ্যাচারকে বিশ্বাস করার এই প্রবণতা থেকেই যায়। এ কারণেই অনেক মিথ্যাচার সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দিব্যি টিকে থাকে। কোন সত্য যদি কারোর মানসিকতার সঙ্গে খাপ না খায় তাহলে হয় সে সেটাকে গণনায় নেয় না, কিংবা অগ্রাহ্য করে বা বিদ্রƒপ করে, নয়ত ধাঁধায় পড়ে যায় অথবা বিপন্ন বোধ করলে সেটার সমালোচনা করে। যেমন, ‘ভ্যাকসিনের কারণে অটিজম হয়‘ কিংবা ট্রাম্প বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন অটিজমের কারণ’ এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা চালু আছে। অথচ এর পিছনে কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ নেই। প্রায় ২ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় যে, যারা ট্রাম্পের সমর্থক তাদের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণাটি প্রবল। এই ধরনের মিথ্যাচার বা ভ্রান্ত ধারণাকে বিশ্বাস করার এমন প্রবণতার কারণেই সামাজিক মিডিয়ার এই যুগে সমাজগতভাবে আমাদের মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করার ক্ষমতা নজিরবিহীন হুমকির মুখে পড়েছে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×