ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণে নতুন স্বপ্ন দেখছে সীমা

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৫ জুলাই ২০১৭

তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণে নতুন স্বপ্ন দেখছে সীমা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ১৮ বছরের সীমা ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পাস করেছেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় এরপর আর পড়ালেখা করার সুযোগ পাননি। সীমার ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা শিখে ভাল চাকরি করবেন। হঠাৎ তার এক আত্মীয়ের কাছে জানতে পারলেন মহিলাবিষয়ক অধিদফতর পরিচালিত জিরানী গাজীপুরে অবস্থিত শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমিতে তিন মাস মেয়াদী দরিদ্র নারীদের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর সীমা সেখানে আবেদন করেন এবং আবাসিক সুবিধাসহ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ পান। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুইং অপারেটর হিসেবে সীমা ৩ মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর ভাগ্য খুলে যায় সীমার। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘প্রশিক্ষণ শেষ করার পরপরই আমি গাজীপুরের একটি গার্মেন্টসে যোগদান করি। আমি কখনও ভাবিনি মাত্র ৩ মাসের প্রশিক্ষণ আমাকে জীবন নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে শেখাবে। এখন আমি মাসে ৬ হাজার টাকা পাচ্ছি। পরিবারে আর্থিকভাবে অবদান রাখার পাশাপাশি কলেজেও ভর্তি হয়েছি। সরকার দরিদ্র নারীদের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছে। সরকারের এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের মত দরিদ্র অনেক নারী স্বাবলম্বী হচ্ছে এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। আমার আশা ভবিষ্যতে আরও ভাল চাকরি করব এবং আমার পড়ালেখাও যথারীতি শেষ করব।’ সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত অনেক পরিবারের মেয়েদের তেমন একটা লেখাপড়া করা সম্ভব হয় না। সীমার মতো অনেক মেয়েকেই জীবন-জীবিকার তাগিদে লেখাপড়া ছেড়ে পরিশ্রমের কোন কাজে নামতে হয়। নারীর দক্ষতা উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নে মহিলাবিষয়ক অধিদফতর পরিচালিত জিরানী গাজীপুরে অবস্থিত শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। নিরাপদ আবাসিক এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আগত ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মহিলা প্রশিক্ষণার্থীদের আধুনিক গার্মেন্টস টেইলরিং, বিউটিফিকেশন, মোবাইল সার্ভিসিং ও বেসিক কম্পিউটার বিষয়ে ৬ মাস মেয়াদে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণার্থীদের বিনামূল্যে হোস্টেলে অবস্থান, খাবারের সুব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া মাসিক ৩০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়। ২০১১ সাল থেকে শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মহিলাদের পাঁচটি ট্রেড কোর্সে মোট ১০০ জন মহিলাকে বিনা খরচে (থাকা-খাওয়াসহ) তিন মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। একাডেমী সূত্রে জানা গেছে, এখানে তিন মাস অন্তর বছরে চারটি ব্যাচে মহিলাদের এসব ট্রেড কোর্সে ভর্তি করানো হয়। এখানে যেসব ট্রেড কোর্সে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেগুলো হলোÑ কম্পিউটার অফিস এ্যাপ্লিকেশন, ড্রেস মেকিং এ্যান্ড টেইলারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সুইং মেশিন অপারেটর, বিউটিফিকেশন এবং মোবাইল ফোন সার্ভিসিং ও ইন্টারনেট বিষয়ে। গত বছর এ প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে বিউটিফিকেশন ট্রেড কোর্সে প্রশিক্ষণ নেন টাঙ্গাইলের সনিয়া। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি নিজেই এখন একটি বিউটি পার্লার খুলেছেন। সনিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, এ প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিবেশ অনেক ভাল। এ প্রশিক্ষণগুলোর যে কোন একটি নিলে কাউকে বসে থাকতে হবে না। নিজের গড়া বিউটি পার্লারে নিজেও কয়েকজন দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত মহিলাকে বিউটিফিকেশনের ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বলে জানান সাথী। শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমির আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা ইউরিদা সাঈদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সুবিধাবঞ্চিত নারীদের বিভিন্ন ট্রেডের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ ও স্বাবলম্বী করে তোলাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। এখানে প্রতিটি ট্রেডের প্রার্থীদের হাতে-কলমে কাজ শেখানো হয়। এ প্রশিক্ষণগুলো দেন একাডেমির নিজস্ব প্রশিক্ষক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা। প্রশিক্ষণ শেষে গ্রেডিং পদ্ধতিতে লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের সনদ দেয়া হয়। ইউরিদা সাঈদ জানান, ‘এ সনদটি প্রার্থীর ইউনিয়ন পর্যায়ের যে কোন বিউটি পারলার, গার্মেন্টস, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চাকরি পেতে সহায়ক হবে। এছাড়া তারা নিজেও ব্যবসা করে আয় করতে পারবেন।’ শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আবাসিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন ১ হাজার ৩৭৮ নারী এদের মধ্যে ৮৫৩ জন চাকরি পেয়েছেন এবং বাকিদের প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া ট্রেনিং ফর ডিসএ্যাডভানটেজড ওমেন অন রেডিমেড গার্মেন্টস’ (আরএমজি) প্রকল্পের অধীনে ২ মাস মেয়াদী অনাবাসিক প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেছেন ৭০৪ নারী এবং বর্তমানে এদের মধ্যে ৬৫৩ জন বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করছেন। বর্তমানে চলমান ব্যাচে ১৭৫ নারী প্রশিক্ষণরত আছেন। শুধু শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি নয় দেশের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে মহিলাবিষয়ক অধিদফতর কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছেÑ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহ বেগম রোকেয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সাভার মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রাজশাহী মহিলা হস্তশিল্প ও কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাগেরহাট মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, দিনাজপুর মহিলা হস্তশিল্প ও কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বগুড়ায় মা ফাতেমা (রা:) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্স দরিদ্র নারীদের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
×