ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে খানিকটা উন্নতি

যমুনা পদ্মার পানি দ্রুত নামছে বন্যার ধাক্কা নিম্নমধ্যাঞ্চলে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৫ জুলাই ২০১৭

যমুনা পদ্মার পানি দ্রুত নামছে বন্যার ধাক্কা নিম্নমধ্যাঞ্চলে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বন্যার বিস্তৃতি দেশের নিম্ন মধ্যাঞ্চলেও। উত্তরের পানি নেমে এবার প্লাবন শুরু হয়েছে মধ্যাঞ্চলে। ফলে মধ্যাঞ্চলে বন্যা দেখা দিচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, এতদিন পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও শুক্রবার তা বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। আর এর প্রভাবেও মধ্যাঞ্চলের জেলা ফরিদপুরের পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চল তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, উত্তর থেকে পানি নেমে আসার কারণে মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মাদারীপুরে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি উত্তরের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা কমতে শুরু করতে পারে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শুক্রবার পর্যন্ত দেশের ১১ নদীর ১৪ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি যে হারে কমার কথা সেভাবে কমছে না। বরং কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে নদীর পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন নদীগুলোর পানি যে হারে কমার কথা সেভাবে কমছে না। যখনই নদীর পানি কমতে শুরু করে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তা আরও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন তিনটি রিভার সিস্টেমে এক সঙ্গে পানি বেড়ে গেলে দেশে বড় বন্যার আশঙ্কা থাকে। তিনি জানান, যমুনা ব্রহ্মপুত্র নদীর পাশাপাশি এখন পদ্মা নদীর আপার সিস্টেমেও পানি বাড়ছে। আপার সিস্টেমে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এবং তা ডেঞ্জার লেবেল পার হয়ে গেলে বড় বন্যা দেখা দিতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, যমুনার পানি নেমে আসার কারণেই মূলত পদ্মা নদীর লোয়ার সিস্টেমে এসে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলেও দেশের নিম্নমধ্যাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধান প্রধান নদনদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে না। সুরমা কুশিয়ারা নদীর পানি কখনও কখনও স্থিতিশীল হয়ে আবার বেড়ে যাচ্ছে। তারা জানান, শুক্রবার পর্যন্ত কোন কোন নদীর পানি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও এখন পর্যন্ত সব নদীর প্রবাহই বিপদসীমার ওপর দিয়ে রয়েছে। তারা বলেন, মূলত দেশের বাইরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন রাজ্যে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যার পানি নেমে আসার কারণে নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা এই অতিরিক্ত পানি দেশের প্রধান তিনটি রিভার সিস্টেমে ধারণ করতে পারে না বিধায় বন্যা দেখা দিয়েছে। তারা বলেন, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বাৎসরিক সম্মিলিত বন্যার প্রবাহ একটিই নির্গম পথ অর্থাৎ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। নদীর পানির স্তরের এই উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারাদেশেই পড়ে। কারণ বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায়। তারা বলেন, দেশে তিনটা মেইন রিভার সিস্টেম, যমুনা রিভার সিস্টেম, গ্যাঞ্জেস রিভার সিস্টেম এবং মেঘনা রিভার সিস্টেম। এই রিভার সিস্টেমের যে ক্যাচমেন্ট এরিয়া তার ৯৩ শতাংশ বাংলাদেশের বাইরে। নেপাল এবং ইন্ডিয়ায় বন্যা এবং বৃষ্টিপাতের কারণেই যমুনায় পানি বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার ৯টি নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে শুক্রবার থেকে আরও দুটি নদী পদ্মা, কপোতাক্ষ এবং পুরাত সুরমা নদী নতুন করে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। শুক্রবার যমুনা নদীর পানি বিপদসীমা লেবেল বৃদ্ধি পেয়ে ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকায় এই সীমা অতিক্রম করেছে। এছাড়া এই নদীর পানি সারিয়াকান্দিতে ৫৮ সেন্টিমিটার, কাজিপুরে ৬২ সেন্টিমিটার এবং সিরাজগঞ্জে ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তারা জানায়, সুরমা কুশিয়ার নদীর পানি মাঝে মাঝে কখনও হ্রাস পেয়ে আবার বাড়ছে। এখন পর্যন্ত এ দুটি নদীর পানি এখন বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আত্রাই ধলেশ্বরী, কপোতাক্ষ, ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে উত্তরের পানি নেমে আসার কারণে গঠাৎ করেই পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমা পার হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফরিদপুরে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ১২ ঘণ্টায় পদ্মার পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে এখন তা বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে ফরিদপুর জেলার পদ্মা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিন ধরে পদ্মার পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই ১০/১৫ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। জেলার সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর ও আলফাডাঙ্গা উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছ। দেশের বন্যা পরিস্থিতি কুড়িগ্রাম ॥ বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাজিবপুর উপজেলার বটতলা এলাকায় পাকা সড়কের ১৫ ফুট ধসে গেছে। এতে করে পার্শ¦বর্তী বালিয়ামারী, জালছিঁড়ার পাড়, মিয়া পাড়া, বটতলা ম-লপাড়া ও কলেজপাড়াসহ ৭ গ্রামের মানুষের যোগাযোগে দুর্ভোগ বেড়েছে। এসব এলাকার লোকজন পার্শ্ববর্তী সড়ক দিয়ে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার ঘুরে রাজিবপুর উপজেলা শহরে যেতে হচ্ছে। নদ-নদী তীরবর্তী চর ও দ্বীপচরসহ জেলার ৭ উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের ৫ শতাধিক গ্রামের প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ গত ৮ দিন ধরে পানিবন্দী জীবনযাপন করছে। সিরাজগঞ্জ ॥ সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। যমুনা পারের বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগও কমেনি। তবে সরকারী ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এদিকে বানের পানির তোড়ে সিরাজগঞ্জের উজানে বাহুকা নামক স্থানে পানি উন্নয়ন বিভাগের নবনির্মিত রিং বাঁধের প্রায় ৩০ মিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ রিং বাঁধ ভেঙ্গে বাঁধ অভ্যন্তরে হু হু করে বন্যার পানি ঢুকছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় আকস্মিকভাবে এই বাঁধ ভেঙ্গে যায়। বাঁধ ভাঙ্গার খবরে বাহুকাসহ আশপাশের এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এলাকার হাজারো মানুষ স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে বাঁধ রক্ষার কাজ করে যাচ্ছে। এ দিকে বাঁধ ভেঙ্গে অভ্যন্তরের বাহুকা, চিলগাছা, ইটালী, ভেওয়ামারা ও গজারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে সয়লাব হয়েছে। রাতেই স্থানীয়রা বাঁধ মেরামতে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ শুরু করে। গাইবান্ধা ॥ জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দী মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ নানা সমস্যায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে নদী ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গো-ঘাট, ফুলছড়ির কুচখালি, হারোডাঙ্গা, কাবিলপুর এলাকা অব্যাহত ভাঙ্গনে এখন বিপন্ন। এরমধ্যে ব্যাপক ভাঙ্গনের ফলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বন্যার পানির স্রোতে কামারজানি ইউনিয়নের কলমু এসএমসি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেবে গেছে। নীলফামারী ॥ একটি স্বেচ্ছাশ্রম বাঁধ উজান হতে নেমে আসা ঢলের বন্যা হতে রক্ষা করে চলেছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা ও লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার চার ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার পরিবার, ফসলি জমি ও মাছ চাষের পুকুরগুলোকে। স্বেচ্ছাশ্রমের এই বাঁধটি এখন হুমকির মুখে। প্রতিনিয়িত তিস্তার উজানের ঢলের আঘাত এই বালির বাঁধটির ওপর আঘাত করছে। তাই নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে এলাকার শতশত মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাঁধটি রক্ষায়। রাজশাহী ॥ অবশেষে পানি বাড়তে শুরু করেছে রাজশাহীর পদ্মায়। কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে হু হু করে পানি বাড়ছে। ফলে রাজশাহী পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এ বছর রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়নের আনসারের ঘাটে মহানন্দা নদীতে নৌকা ডুবে দুই কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল শুক্রবার বেলা ১টার পরে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। মৃত দুই কিশোর ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়নের পারধূমি হায়াতপুর গ্রামের বাবলু আলীর ছেলে আল আমিন (১০) ও একই গ্রামের আনারুল ইসলামের ছেলে ওয়াহেদ আলী (১৬)। তারা আপন চাচাত ভাই।
×