ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এক ডুবে যাওয়া সামপানের কাহিনী

চারটি কবিতা -কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১৪ জুলাই ২০১৭

চারটি কবিতা -কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

দিগন্তের চক্রবালে, আধো মায়াতন্দ্রাজালে কে তুমি সন্মোহিনী? নীড়ের মত অস্থির, নীড়ে ফেরার ভিড় জাদুকরী মায়াবীনি? হাত কবে ধরেছিলে কত কথা বলেছিলে, হৃদয়ের গভীর গহনে। স্মৃতির বালুরাশি, কত কান্না, কত হাসি হারিয়েছে কোন বিহনে। সেদিনের রৌদ্র প্রখর, কিংবা জমে থাকা ঝড় আছড়ে কি পড়েছিল? নির্জন একাকি মন, শ্রান্ত ক্লান্ত তখন, তটভূমে পড়েছিল? কিংবা সেই জোছনা রাত, হাতে ছিল তার হাত, মন ছিল সপনের উড়ান। হাজারো চাঁদের ভিড়ে মন ছিল নিজ নীড়ে, উর্মিমালায় কল্পনার সামপান। জোছনার শেষে, আলোকের রেশে মনের আকাশ সেজেছিল লাল। সামপানের দাড়, বাধ মানেনি আর, ছুটেছিল দিগচক্রবাল। সামপান ডুবেছিল, দেহ খণ্ড এসেছিল, নির্জন মন সৈকতে। ঝাউবন কেঁদেছিল, ঝড়ো লোনা বাতাস শুধিয়েছিল হারানো গহন দ্বৈরথে। ** একটি মেয়ের গপ্পো জন্ম থেকে শুনে আসছে, মা বলছে, খারাপ কাজ করতে নেই। অথচ মা-ই সেই খারাপ কাজটা করল। দুদিনের জ্বরে চলে গেল। সদা ব্যস্ত বাবার দেখা মেলে না। এটা মায়ের খারাপ কাজ না? ঘণ্টা বাজা অবধি, টাই খোলা অবধি, স্কুল সঙ্গে থাকে। তারপর একরাশ একা ঘিরে রাখে। আজ ক্লাসে হলো কতকিছু, চুরি করে খাওয়া লিচু থেকে ক্লাসের মনিটর হওয়া, আসার পথে ফুচকা খাওয়া। কোন কিছুই তো বলা হলো না! এটা মায়ের খারাপ কাজ না? চেয়ার টেবিলকে ছাত্র বানিয়ে, স্কেলের শাসন করিয়ে, কিংবা দেওয়ালকেই গল্প বলে, পাগকে নিয়ে কোলে, তার দিন আর কাটে না! এটা মায়ের খারাপ কাজ না? প্রথম প্রেমের পরশ পাওয়া, প্রথম মনে অন্য হাওয়া। দৌড়ে এসে ইচ্ছে করে, মনে যা আছে উজাড় করে, বলতে কাউকে। কিন্তু পর্দার ফাকে দেখা সদাব্যস্ত বাবার অডির ধোঁয়া, তার একলা বালিশে কান্না পাওয়া। হঠাৎ সবই ফাঁকা, হঠাৎ সবই একা, কিছু আর ভাললাগে না। এটা মায়ের খারাপ কাজ না? নিঝুম দুপুরে বারান্দায়, দোলনা একা দোল খায়, রেলিংগুলো তার সঙ্গী। করে নানান অঙ্গভঙ্গি, পাগ তাকে হাসাতে চায়, কিন্তু তার হঠাৎ কান্না পায়। তিনতলার এই বারান্দায় ঝুঁকে আসা আমগাছটায়, একটানা কোন পাখি ডাকে, হঠাৎ মনে পড়ে মাকে। একলা দুপুরে তার গল্প বলা, কিংবা দুষ্টুমির কানমলা। সব সে ফিরে পেতে চায়। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল তা জানে না। এটা মায়ের খারাপ কাজ না? ** একা মানে একা মানে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, একা মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। একা মানে রাতের শেষ বাসের জানালা। একা মানে অন্তহীন নিরালা। একা মানে রাস্তায় অকারণে দেরি করা, একা মানে হঠাৎ বন্ধুর বাড়ি ঢুঁ মারা। একা মানে খাবার কিনে বাসায় ফেরা, একা মানে নেই প্রশ্ন, নেই জেরা। একা মানে তালা খুলে ঢোকা, একা মানে নীরব কথা বলা। একা মানে পৃথিবী কি ধোঁকা? একা মানে শুধুই পথ চলা? একা মানে রাতের আঁধারে কাউকে খোঁজা? একা মানে নিঃস্তব্ধ সরব দুপুরবেলা। একা মানে নিরন্তর নিজেকে বোঝা? একা মানে নিজের সঙ্গে খেলা। ** হারিয়ে যাওয়ার গান জীবনের রং কি ধুয়ে যায়? অতীত কি দেয় হাতছানি? প্যালেটের রং কি মুছে যায়? পড়ে থাকে বিবর্ণ রেকাবখানি? আজকের হাসিগান কি হারিয়ে যায় আগামীর কোলাহলে? আজকের কথা কি ফুরিয়ে যায় কালের হোমানলে? গায়ত্রীর মন্ত্র হারায় রেশ নিঃশব্দের কাছে। পিদিম তো শেষ তুলসীতলার পাছে। হাসি কান্না দোল খায় না আর ইটকাঠের গদ্যে, সকালের রোদ্দুর গল্প বলে না আর জীবনের রংবেরং-র পদ্যে। কল্পনা আর মেলে না ডানা, বিকেলের সোনা মেখে। জীবন আর দেখে না জীবনকে নানা স্বাদে চেখে। পিদিমের আলো আর করে না ধাওয়া আধার, রাস্তার নিওন নিয়েছে তার জায়গা। আব্রুতা পড়েছে খসে, শালিনতার ঠাঁই এখন খোলা ইটের পেয়াদা। পেলবতা মুছে যাওয়া, জীবনের রং ধুয়ে যাওয়া, এটাও কি জীবনের রূপ? সময়ের কষাঘাতে, নির্মম নিয়তির হাতে, পরাজিত জীবন নিশ্চুপ।
×