ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৪ জুলাই ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) শাহ সুজার প্রথম পরাজয় গত এক মাসের অভিযানে বেশ শুকিয়ে গেছেন ছোট শাহজাদা সুলাইমান। চেহারায় লাবণ্য কমে এসেছে। রাত জাগা ক্লান্তি চোখের নিচে। তবে পেশীগুলো পাটের দড়ির মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। গঙ্গার অপর পাড়ে বেনারসের কিছু দূরে বাহাদুরপুরে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আগেভাগে এসে তাঁবু গেড়েছেন শাহ সুজা। ছোটখাটো এক তাঁবুর নগরী বানিয়ে ফেলেছেন এলাকাটি। দিনরাত তার গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে গিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা সুলাইমানের মাথায় ভর করে। বড় চাচা সুজাকে ঠেকাতে পারলে আরও দুই চাচা বাকি আছেন। মেজ চাচা আওরঙ্গজেব ও ছোট চাচা মুরাদের সঙ্গে যদি সুজা আড়ালে সন্ধি করে থাকেন তবে সুলাইমানের আব্বাজান দারা কি পারবেন তিন ভাইকে এক সঙ্গে সামলাতে? এই প্রসঙ্গে রাজা জয় সিংয়ের সঙ্গে আলাপ করলে মনে স্বস্তি লাগে না। মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন চতুর রাজা। সহজে কিছু বলতে চান না। সম্রাট শাহজাহানের আদেশে এত দূর এসেছেন কথাটি বার বার শোনাতে থাকেন। কোথায় যেন গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বয়সে নবীন বিবেচনায় তাকে বিস্তারিত জানাচ্ছেন না হয়ত। দারা পুত্র হিসেবে আলগা সম্মান দেখাচ্ছেন কেবল। সুলাইমান কখন সুজার বাহিনীকে আক্রমণ করবেন সেই নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন সবাই। ভেতর হতে ছটফট করতে থাকেন সুলাইমান। আক্রমণ যদি করতে হয় তবে বসে থেকে সময় অপচয় করা কেন? দারা চেয়েছেন সুজার প্রতিরোধ ও সপরিবারে বন্দী করতে। গোপন সূত্রে জেনেছেন সুজার আদরের কন্যা গুলরুখ বানু রাজমহলে থেকে গেছেন। সঙ্গে আসেননি। সঙ্গে দারা আরও বার্তা দিয়েছেন প্রয়োজনে রক্তপাতে দ্বিধা করা যাবে না। অন্যদিকে দাদাজান সম্রাট শাহজাহান জানিয়ে দিয়েছেন, সন্ধি চুক্তিতে বাধ্য করাতে হবে। অযথা রক্তপাত তার কাম্য নয়। সেনাপতি দিল্লীর খানের ধারণা সুজা আত্মসমর্পণ করতে এত দূর আসেননি। রাজা জয় সিং মনে করেন সুজার আগ্রাসনে আওঙ্গজেবের মদদ আছে। সুতরাং তাড়াহুড়া না করে ভেবে চিন্তে এগুতে হবে। দোটানায় পড়ে গেলেন সুলাইমান। যা করার তা নিজের বিবেচনায় করা ছাড়া গতি দেখলেন না তরুণ শাহজাদা। রাতে প্রহরা দ্বিগুণ করলেন। নিজ তাঁবুর পাশে বাছাই করা সেনাদলকে সজাগ থাকতে বললেন। এদের অধিকাংশই দিল্লীর খানের অনুগত সেনাদল। ১৬৫৮ সাল, ২৪ ফেব্রুুয়ারির সন্ধ্যা রাত। শাহজাদা সুজার তাঁবু হতে মাঝরাতে অব্দি হৈ হুল্লোড় আর বাঈজীদের নূপুরের আওয়াজ ভেসে আসে। অর্ধ কোটি টাকা সমমূল্যের দো আশিয়ানা মঞ্জিলের রাজকীয় তাঁবুতে আনন্দ উৎসবের কোন কমতি নেই। পুরো ফরাশখানা বয়ে নিয়ে এসেছেন সুজা। আঠারো স্তম্ভের ওপর কাঠের পাটাতন নির্মিত দুই তলাবিশিষ্ট দো আশিয়ানা তাঁবুটি অনেক দূর হতে দেখা যায়। শক্তিশালী নৌবহর আর সুসজ্জিত গোলন্দাজ বাহিনী সঙ্গে এনে সুজা ধরেই নিয়েছেন তিনি দিল্লীর সম্রাট হতে চলেছেন। শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। তাই রাজমহলের বিশাল হেরেমখানা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। কাকে বাদ দিয়ে কাকে নেবেন তা ঠিক করতে পারেননি। সবাই আগ্রা বিজয়ের রাজসাক্ষী হতে চান। সুজার সেনাপতির দায়িত্ব মেয়ের জামাই মুহম্মদ সুলতানের হাতে তুলে দিলেও ঘনিষ্ঠ পরামর্শক আলীবর্দী খাঁকে সমান গুরুত্ব দেন। খবর পেয়েছেন নদীর অন্য পাড়ে দারার বড় ছেলে সুলাইমান পৌঁছে গেছেন। সঙ্গে এসেছেন এক সময়ের প্রিয় বন্ধু রাজা জয় সিং। মনে মনে আফসোস ঝরে পড়ল সুজার। ভেতর ভেতর অনেক আদর জমিয়ে রেখেছিলেন সুলাইমানের জন্য। যত যাই হোক বড় ভাইয়ের ছেলে বলে কথা। তার অনেক গুণের কথা শুনেছেন তিনি। দেখতে শুনতে নাকি দাদাজান জাহাঙ্গীরের মতো হয়েছে। শ্বেত পাথরের পানপাত্রে চুমুক দিয়ে মনে মনে ঠিক করলেন দিল্লী জয় সম্পূর্ণ হলে সুলাইমানকে তিনি বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করবেন। সুজার ভাবনায় ছেদ পড়ল। প্রহরী কুর্নিশ করে জানালো আলীবর্দী খাঁ এসেছেন দেখা করতে। ইশারায় গায়ক ও বাঈজীদের বিদায় নিতে বললেন সুজা। -আপনার কি মনে হয় ওরা আমাদের আক্রমণ করতে নাকি কোন সন্ধি করতে এসেছে জনাব আলীবর্দী খাঁ ? বাঁকানো গোঁফে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলেন সুজা। -আমার মনে হওয়ায় কি যায় আসে হুজুর। আপনি তো আর খালি হাতে আসেননি। এসেছেন রীতিমতো যুদ্ধের পরোয়ানা নিয়ে। ওদিকে সম্রাটের সৈন্যরা তো আর দিল্লী থেকে দোস্তালি পাতাতে এত দূর আসেনি। আলীবর্দী খাঁর কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি টের পেলেন সুজা। - আপনার অসন্তুষ্টির কারণটা কি জানতে পারি? - নিশ্চয় হুজুর। মুঘলদের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিনতম এক যুদ্ধ যাত্রায় আমরা ব্যস্ত আছি। এত রীতিমতো রাজদ্রোহ। খোদ সম্রাট এখনও বেঁচে আছেন। - এইভাবে পুতুলের মতো বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না। দারা আমাদের সম্রাটকে কৌশলে বন্দী করে রেখেছেন আর হিন্দুস্থানের চাবি নিজ হাতে নেয়ার ফিকির করছেন। এটার সুরাহা করতেই আমার দিল্লী অভিযান। - কিন্তু এই কি অভিযানের নমুনা? নিজের হতাশা আর চেপে রাখতে পারলেন না অভিজ্ঞ আলীবর্দী খাঁ। -কেন কি সমস্যা? জানতে চান সুজা। -পুরো বহরটিকে দেখলে মনে হবে যেন আস্ত এক প্রমোদশালা। শিবির পরিদর্শন করে দেখলাম সাধারণ দেশীয় পদাতিক সৈন্যরা বিদেশী সৈন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচ-গান-বাঈজী আর সুরায় মেতে আছে। ইংরেজ ফরাসি আর ওলন্দাজ সৈন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করে তারা যাবতীয় কুকর্মের তালিম নিচ্ছে। কি হচ্ছে এসব হুজুর? দুই হাত নেড়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বোঝাতে চাইলেন আলীবর্দী। -সুলতান মুহম্মদ বলেছে এটাই নাকি যুদ্ধ কৌশল। শত্রুপক্ষ অবগত হবে আমাদের যুদ্ধে মন নেই। তাদের মধ্যেও তার প্রভাব পড়বে। তখন আমরা পাল্টা আক্রমণ চালাব। কিন্তু আপনার বর্ণনা মতে তামাশা একটু বেশি হচ্ছে মনে হয়। -গুস্তাকী মাফ করবেন মহামান্য। আপনার জামাই এখনও যুদ্ধ বিদ্যায় অনেক নাবালগ। কেবলমাত্র মাথায় শেওলা জমলে এই রকম বুদ্ধি জন্মায়। -থামুন। আমি বুঝতে পারছি তার ওপর আপনার অহেতুক ক্ষোভ জন্মেছে। বাস্তবিক কথা হচ্ছে আমি নির্দেশ দিয়েছি মূল যুদ্ধের আগে সবাইকে সামান্য আমোদ ফুর্তি করতে। - মহামান্য আমি আরও জেনেছি শাহজাদা সুলাইমানের সঙ্গে দিল্লীর খান রুহেলা এসেছেন। তিনি অনেক তৎপর একজন সেনাপতি। শুনেছি গত কিছুদিন ধরে মূল শিবিরে তার অনুগত সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে না। আমার ধারণা তারা চোরাগুপ্তা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আপনার উচিত হবে সুলতান মুহম্মদকে সাবধান করে দেয়া। আমি জানালে তিনি আমার কথা আমলে নেবেন না নিশ্চিত। -খামোখা চিন্তিত হয়ে পড়ছেন উজির সাহেব। আমাদের নৌবহরের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে নদী পার হওয়া সহজ হবে না। আর ভুলে যাবেন না দেহরক্ষী হিসেবে আমার সঙ্গে আছে বরহার সাইদ গোত্রের বিশ্বস্ত সৈন্যদল। - তা জানি হুজুর। - তবে আর বাড়তি দুশ্চিন্তা কেন? যান, আপনিও আমোদ ফুর্তি করুন। - মহামান্য মনে হয় শীতকালের মতিগতি সব ভুলে বসে আছেন। রাত গভীর হলে নদীর বুকে ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় সব কিছু। খালি চোখে দুই হাত দূরের জিনিস ঠিক মতো দেখা যায় না। আলীবর্দী খাঁর যুক্তি শুনে সামান্য অস্বস্তির ভাঁজ পড়ল শাহ সুজার কপালে। দূরে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে তাঁবুর শিবিরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মশালের অস্পষ্ট আলোর মিছিল ছাড়া কিছুই দেখতে পেলেন না শাহজাদা সুজা। আলীবর্দী খাঁর ধারণা সত্য প্রমাণিত করে কুয়াশা ঢাকা ভোরে অতর্কিতভাবে সুলাইমানের বিশেষ প্রশিক্ষিত সেনাদল সুজা শিবির আক্রমণ করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুজার রক্ষণব্যূহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। আহত সৈন্যদের আর্তচিৎকারে কেঁপে উঠল ভোরের বাহাদুরপুর। রাতের শেষ প্রহরে বেগম পিয়ারা বানুর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন শাহ সুজা। মানুষ ও ঘোড়ার সম্মিলিত প্রবল চিৎকারের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল সবার। কিছু বোঝার আগেই সুজা দেখলেন প্রাণ ভয়ে ভীত হরিণীর মতো দৌড়ে তার তাঁবুতে ঢোকার জন্য হুড়োহুড়ি করছেন পঞ্চাশজনের বেশি বাঈজী। সুজার লাগোয়া পাশের তাঁবুতে ছিলেন তারা। তাড়াহুড়ায় প্রায় সবাই লেহেঙ্গা-ঘাগরা-ওড়না ফেলে এসেছেন বা সময় পাননি। শাহজাদা সুজা তাদের শেষ আশ্রয়। তাঁবুর ভেতর আশ্রয় নেয়া হেরেমখানার এতগুলো নগ্ন-অর্ধ নগ্ন সুন্দরীদের এক সঙ্গে দেখে আসন্ন যুদ্ধের পরিণতি ভুলে গেলেন বাংলার সুবাদার। ঘুম জড়ানো চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন সংঘবদ্ধ সৌন্দর্যের দিকে। ঘটনার ধাক্কা সামলাতে না পেরে পিয়ারা বানু জ্ঞান হারালেন সুজার কোলে। (চলবে)
×