ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ওবায়েদ উল হক চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৪ জুলাই ২০১৭

ওবায়েদ উল হক চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক

‘ওবায়েদ উল হক চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক’ গ্রন্থটি মূলত একটি গবেষণামূলক তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। বিশিষ্ট গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক কর্মী শামীমা চৌধুরী গ্রন্থটির নির্মাতা। অর্থায়ন এবং প্রকাশনায় বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। গবেষণার আলোকে ওবায়েদ উল হকের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের ওপর সুসংবদ্ধ আলোচনায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির প্রকাশকাল ২০১৭ সালের জুন মাসে। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার ওবায়দে উল হকের জীবনের বিচিত্র আলোচনায় সঙ্গত কারণে এসে যায় তৎকালীন সমাজ, সংস্কৃতি এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিস্তৃত বলয়। লেখক শামীমা চৌধুরীও সেই দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে খ্যাতিমান সাংবাদিকের আদর্শ, সততা, দেশপ্রেম, সচেতন প্রত্যয় এবং পর্বত প্রমাণ ব্যক্তিত্বের এক উজ্জ্বল জীবনালেখ্য পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসনামলে কিভাবে সাংবাদিকতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের যাত্রা শুরু হয় তারও একটি ঐতিহাসিক পটভূমি লেখক পাঠকের কাছে পৌঁছে দেন। ১৯১১ সালে জন্ম নেয়া ওবায়েদ উল হক ৩০ এর দশক থেকে উপমহাদেশীয় উত্তাল তরঙ্গের ভাসমান স্রোতে কিভাবে নিজের আদর্শ ও লক্ষ্যকে স্থির করে কাক্সিক্ষত পথে এগিয়ে যান তার একটি ধারাবাহিক চিত্রও অনিবার্যভাবে পাঠকের কাছে ধরা দেয়। কবি নজরুলের সঙ্গে ওবায়েদ উল হকের আলাপচারিতাও প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব যখন সারাবিশ্বে আলোড়ন তোলে সেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় কেঁপে ওঠে অবিভক্ত বাংলা। যার পরিণতিতে ১৯৪৩ সালের সেই সর্বগ্রাসী মন্বন্তর, যা চিন্তাশীল বিজ্ঞজনদের মনন ও সৃষ্টি দ্যোতনায় প্রচ- ঝড় তোলে। ওবায়েদ উল হকও তাড়িত হন সেই বিষণœ প্রতিবেশের চরম দুঃসময়ের সঙ্কটাবর্তে। মনন শীলতার বিদগ্ধ অনুভবে লিখলেন জীবনের সর্ব প্রথম গল্পগাথার এক করুণ আলেখ্য ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’। শুধু লিখলেন না, যাদের কারণে এই অনবদ্য রচনা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। সে সময় তার কাছে মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র নয় চলচ্চিত্রকেই মনে হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ। তারই তোড়জোড় শুরু করলেন কলকাতায় এসে। ওবায়েদ উল হকের এক সাক্ষাতকারে স্পষ্ট হয় প্রথমে তিনি কিছুটা আইনগত বাধার সম্মুখীন হলেও পরবর্তীতে তা বিধি অনুযায়ী মীমাংসার ফলে ছবি করার অনুমোদন পান সরকারের কাছ থেকে। ’৪৭ এর দেশ বিভাগের অব্যবহৃত পূর্বে অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে ছবি বানানোর লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। বিভিন্ন সমস্যায়ও পড়েন মুসলমান হিসেবে। সে সব পাশ কাটাতেও সময় লাগেনি তার আদর্শ এবং ব্যক্তিত্বের অবিচলতায়। লেখক সাবলীলভাবে, দক্ষ নির্মাণশৈলীতে ওবায়েদ উল হকের জীবন লড়াইয়ের অনবদ্য কাহিনী পাঠকদের উপহার দিতে পেরেছেন। এ জন্য তাকে আন্তরিক ও সশ্রদ্ধ অভিবাদন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার নিবেদিত দেশপ্রেমকে তুলে ধরতে লেখক ওবায়েদ উল হকের সাংবাদিকতার জীবনকে দর্শকের কাছে নিয়ে আসেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে বিজয়ের পতাকা উড়াই শুধু নয় পরবর্তী কাজের পরিধি নির্ধারণ করাও ছিল একেবারে সময়ের দাবি। তখন তিনি ‘পাকিস্তান অবজারভারে’র যুগ্ম সম্পাদক। নিজের জবানীতে ব্যক্ত করেছেন সেই অসম সাহসের দুর্লভ মুহূর্তগুলো। ১৭ ডিসেম্বর কিভাবে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে শুধু ‘অবজারভার’ নামে পত্রিকাটি বের করলেন হরেক রকম বাধাবিপত্তির মধ্যে। শুধু তাই নয় ৪-৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ শব্দটি যোগ হলো। এই এক বিস্ময়কর স্মৃতি চারণ যা তাকে জীবনভর আবেগঘন আনন্দে আপ্লুত করেছে। এই কৃতী সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার আইনের ওপর ডিগ্রী নিয়েও আইনকে পেশা হিসেবে নিলেন না। অবিভক্ত বাংলার সিভিল সার্ভিসের সদস্য হয়েও আমলাতান্ত্রিক জিটিলতায় নিজেকে বাঁধলেন না। তার চিন্তাশীল আর সৃজনশীল উদ্যোমকে এতই গুরুত্ব দিলেন যে নির্মোহ তাড়নায় বেছে নিলেন সাহিত্যিক আর সাংবাদিকতার অনিশ্চিত জীবন। তৃপ্তি পেয়েছেন, অনিশ্চয়তাকে জয় করেছেন। সর্বোপরি আনন্দ আর নান্দনিক অনুভবে জীবন কাটিয়েছেন। শামীমা চৌধুরী এই বলিষ্ঠ আর যশস্বী সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকারের বিচিত্র জীবনকে এক সৃতায় বেঁধে এক সূক্ষ্ম আর দক্ষ রচনা শিল্প যেভাবে পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। ৯৬ বছর পর্যন্ত জীবন পাওয়া এই কৃতী ব্যক্তিত্বকে আলোচনা করতে গিয়ে যেভাবে প্রায় ৭০ বছরের (ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বলয় পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে তা মননশীল জগতকে নানামাত্রিকে পূর্ণ করতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবেÑএই আশা ব্যক্ত করে গ্রন্থটির সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করছি।
×