ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাগেরহাটের বৈটপুর গ্রামে স্কুলছাত্রীর সাইকেল চালানো

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৪ জুলাই ২০১৭

বাগেরহাটের বৈটপুর গ্রামে স্কুলছাত্রীর সাইকেল চালানো

উদ্দীপন বদর সামছু বিদ্যানিকেতন শুরু থেকেই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত শিশু-কিশোরদের নিয়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। যেখানে ছেলে-মেয়ে উভয়েই লেখাপড়া শেখার অধিকার পায়। ফলে গ্রামের পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলিতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণটি প্রতিদিনই মুখরিত হয়ে ওঠে। অবৈতনিক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যচর্চা থেকে শুরু করে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানে ও নিজেদের দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে অনলাইন (স্কাইপ) কার্যক্রমের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও তাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে পারে। সবার ক্ষেত্রে না হলেও যারা দক্ষ এবং যোগ্য কিংবা ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন তাদের বেলায় কার্যক্রমের অগ্রাধিকার বর্তায়। তবে সেখানে ছেলেমেয়ের কোন ফারাক নেই। সুতরাং মেয়েরাও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে। শিক্ষক নির্বাচনের বেলায়ও যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি। যার কারণে নারী-পুরুষের কোন বৈষম্য দৃষ্টিগোচর হয় না। ফলে পুরুষের চাইতে নারী শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। এ ব্যাপারে গ্রামীণ রক্ষণশীল সমাজের সামান্য ওজর আপত্তি উঠলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে কখনও আমল দেয়নি। আর এসব কারণেই মেয়েরা সাহসী, আত্মবিশ্বাসী এবং আধুনিক সমস্ত প্রযুক্তিকে গ্রহণ করার যোগ্যতায় নিজেদের প্রমাণও করতে পেরেছে। সাইকেল চালানোও মেয়েদের নতুন চৈতন্যের এক অভিনব কর্মকৌশল। এক সময় সাইকেল চালানো ছিল ছেলেদের একচেটিয়া অধিকার এবং সক্ষমতা। সময়ের পরিবর্তনে মেয়েরাও কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি জায়গায় নিজেদের প্রমাণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গ্রামে-গঞ্জের মেয়েরা আজ কোন অংশেই ছেলেদের তুলনায় পিছিয়ে নেই। হাতে গোনা কয়েকজন হলেও এই সাইকেল চালানোতে মেয়েরা সাহসী এবং পারদর্শী হয়ে ওঠেছে। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মনে হয়েছে এটা অত্যন্ত একটি সহজ ব্যাপার যা মূলত চর্চার ওপর নির্ভর করে। যে কোন মেয়ে চাইলে এই সাইকেল চালানো তেমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। স্কুলে প্রথম সাইকেল চালিয়ে আসা শুরু করে অনন্যা। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী অনন্যা নবম শ্রেণী থেকে সাইকেলে চড়ে স্কুলে আসে যা অন্যান্য ছাত্রীকে উদ্দীপ্ত আর উৎসাহিত করে। সে এই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে এখন কলেজের শিক্ষার্থী। নবম শ্রেণীর ছাত্রী মারিয়া জামান মুন ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই সাইকেল চালাতে শেখে এবং স্কুলে নিয়মিত সেভাবেই আসে। মাও এই প্রতিষ্ঠানের একজন স্বাস্থ্যকর্মী। নিঃসঙ্কোচে কোন ধরনের সমস্যা ছাড়াই সাইকেলে চড়ে স্কুলে আসতে তার কখনও অসুবিধা হয়নি। বিজ্ঞানের ছাত্রী মুন ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায়। বাল্যবিয়েকে কোনভাবেই মানা যায় না বলে তার দৃঢ় অভিমত। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ছাড়া বাল্যবিয়েসহ নারী নির্যাতনকে রোধ করা যাবে না বলে বিশ্বাস করে। সমাজের অর্ধাংশ মেয়েরা যখন সব ধরনের অধিকার আর সুযোগ পাবে সেভাবে দেশও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তার মতে, তথ্যপ্রযুক্তিতেও মেয়েদের যোগ্যতম হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। আসমা আখতার ইতিও নবম শ্রেণীর ছাত্রী। কমার্সের শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তার আসনে বসাতে চায়। সপ্তম শ্রেণীতে ক্লাস করার সময় থেকেই সে সাইকেলে চড়ে স্কুলে আসা শুরু করে। বাবা রাজমিস্ত্রি আর কিছু মাছের ঘেরও আছে। মা গৃহিণী। মায়ের উৎসাহ-উদ্দীপনায় তার সামনে এগিয়ে চলা। পরিবারের সম্মতিতেই সাইকেল চালানো শেখা এবং পরবর্তী সেভাবে স্কুলেও আসা। বাল্যবিয়ে আর নারী শিক্ষাকে বুঝতে না পারলে মেয়েদের জীবনের অনিবার্য দুর্ভাগ্যকে এড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। সর্বক্ষেত্রে একজন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যা যা করণীয় সবই করতে হবে বলে তার জোরালো অভিমত। আধুনিক প্রযুক্তিতেও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করার স্বপ্ন নিয়ে সে তার শিক্ষা জীবনকে আরও এগিয়ে নিতে চায়। সানজিদা রহমান মিম। কমার্স বিভাগের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। অষ্টম শ্রেণী থেকে সে সাইকেলে চড়ে স্কুলে আসে। বাবা ব্যবসায়ী আর মা-গৃহিণী। ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখলেও চাকরির প্রতিও তার সমান আগ্রহ আছে। পেশা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সফলতা অনেক বেশি জরুরী। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতেও নিজেকে সমানভাবে তৈরি করতে চায়। বাল্যবিয়েকে ঠেকানোর দায়িত্ব প্রতিটি মেয়ের এই ধারণা ব্যক্ত করে নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়ার উপরও বিশেষ গুরুত্ব দেয় মিম। নওরীন দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। একজন চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়। সময় বাঁচানোর তাগিদে নবম শ্রেণী থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে নওরীন। নির্ভয়ে, শঙ্কাহীনভাবে সাইকেল চালাতে আজ পর্যন্ত তার কোন অসুবিধাই হয়নি। বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধিকে রোধ করতে হবে মেয়েদের। যেভাবে আজ তারা সাহসের সঙ্গে ছেলেদের পাশাপাশি সাইকেল চালানোতে পারদর্শী হতে পেরেছে সেভাবে তারাই সমাজের সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে মেয়েরা সমস্ত বন্ধনজাল থেকে মুক্তি পাবে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বলে নওরীনের ধারণা। যার জন্য শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে মেয়েদের সার্বিক অংশ সব থেকে জরুরী। নওরীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। যা এই বিদ্যানিকেতনের দক্ষ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক ছাত্রছাত্রীই স্কাইপ কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে। এখানেও মেয়েদের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক।
×