ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য কত?

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১৪ জুলাই ২০১৭

সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য কত?

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৬’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের টাকা রাখার পরিমাণ বেড়েছে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা হয়, এতদিন এমনটিই মনে করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সুইস ব্যাংকে জমা হওয়া অর্থ পাচারকৃত নয়, বরং এগুলো বাংলাদেশের সম্পদ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক দেব প্রসাদ দেবনাথ বলেন, ‘সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ব্যবসা বাড়ায় যেখানে ধন্যবাদ পাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো অপ-প্রচার হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কোন ব্যক্তির সেখানে হিসাব খোলার সুযোগ নেই। যা আছে সেটা হলো ব্যাংক টু ব্যাংক ব্যবসা।’ তিনি বলেন, ‘সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব হয়, সেটি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে। লেনদেন বেড়েছে। এর ফলে গত এক বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ব্যবসা বেড়েছে ২০ শতাংশ।’ এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে জানান, সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের বিষয়টি বাস্তবে মোটেই তেমন কিছু নয়। টাকার যে হিসাব গণমাধ্যমে বেরিয়েছে তা সুইস ব্যাংকের সঙ্গে এ দেশের লেনদেন ও সম্পদের হিসাব। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সুইজারল্যান্ড যে তথ্য প্রকাশ করে তা হলো সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশী নাগরিকদের হিসাবে কী পরিমাণ অর্থ জমা আছে সেইটা। এখানে ব্যাংক টু ব্যাংক কী ধরনের লেনদেন করে সেটা বিবেচনার বিষয় নয়। কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ধরনের ব্যাখ্যা দিলেও বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের পাচার করা অর্থই সুইস ব্যাংকে জমা হয়। তিনি বলেন, সুইস ব্যাংকে জমা হওয়া টাকার অধিকাংশ এই দেশ থেকেই গেছে। অবশ্য কিছু টাকা ওই দেশে থাকা অথবা অন্য কোন দেশে থাকা বাংলাদেশীদের থাকতে পারে। প্রসঙ্গত, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৬’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশী নাগরিকদের এক হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগের বছরের চেয়ে এ জমার পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ বেড়েছে। এসএনবির প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০০৭ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থ জমার তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সাল থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ জমার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০১২ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা, আর এখন তা ৩৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এদিকে, গত ২ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এতে বলা হয়েছে, আমদানি রফতানিতে আন্ডার ভয়েস এবং ওভার ভয়েসের মাধ্যমেই প্রধানত এই অর্থ পাচার করা হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ বাংলাদেশের দুটি বাজেটের সমান। জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৫-২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য অনুযায়ী, মোট পাচার হওয়া অর্থের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমদানি করা পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ বাইরে পাচার করা হয়। এর বাইরে অফসোর কোম্পানির মাধ্যমেও বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। গত বছরের মে মাসে দ্বিতীয় দফায় পানামা পেপারস-এ বাংলাদেশের অন্তত ৫০ ব্যক্তি ও ৫টি প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। যারা অফসোর কোম্পানি স্থাপন করেছেন দেশের বাইরে। কর ফাঁকি দিয়ে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করা হয় এইসব অফসোর কোম্পানির মাধ্যমে। কিন্তু গত মঙ্গলবার সংসদে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেক উন্নত। ফলে কাছের অন্য দেশের মতো আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব সুইস ব্যাংকের মাধ্যমেও হয়ে থাকে। তিনি বলেন, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আমরা দেখেছি, সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে অনেক লেনদেন হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের খাতে সুইস ব্যাংকের সম্পদ হচ্ছে ২০১৬ সালে এক হাজার ২৩ কোটি টাকা। এই সময়ে তাদের দেনা পাঁচ হাজার ৫৬০ কোটি। অর্থাৎ এক হাজার ৮২৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং তাদের কাছে জমা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
×