ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তৈরি পোশাক হোঁচট খাওয়ায় রফতানি প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১৪ জুলাই ২০১৭

তৈরি পোশাক হোঁচট খাওয়ায় রফতানি প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা

রহিম শেখ ॥ প্রতি বছর তৈরি পোশাক রফতানির ওপর ভর করেই আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এবার তৈরি পোশাকে প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় সার্বিক রফতানি আয় কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি এসেছে এ খাতে। রফতানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের দাম ও চাহিদা কম, ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী, গ্যাস-বিদ্যুত সঙ্কটে উৎপাদন ব্যাহত ও সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলার নেতিবাচক প্রভাবে রফতানি আয় কমেছে। তাদের মতে, রফতানি প্রবৃদ্ধিকে ইতিবাচক ধারায় ফেরাতে রফতানিকারক, ইপিবি ও রফতানি উন্নয়নে বিদেশে কর্মরত মিশনগুলো এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগ নেয়া জরুরী। এছাড়া সরকারের নীতি সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতের বিকল্প পথের সন্ধানে এখনই নামতে হবে বলেও মনে করেন তারা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির প্রকাশিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের রফতানির হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিভিন্ন পণ্য থেকে রফতানি আয় এসেছে তিন হাজার ৪৮৩ কোটি ৫০ লাখ (৩৪.৮৩ বিলিয়ন) ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৭০০ কোটি (৩৭ বিলিয়ন) ডলার। সর্বশেষ রফতানি আয় কম হয়েছিল ২০০১-০২ অর্থবছরে। তখন তার আগের বছরের তুলনায় রফতানি আয় কমে গিয়েছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এরপর প্রবৃদ্ধির অংকে হেরফের হলেও তা সব সময়ই ১ দশমিক ৬৯ শতাংশের বেশি ছিল। বাংলাদেশ রফতানিতে রেকর্ড করেছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে। সেসময় প্রবৃদ্ধি হয়ছিল ৪১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ইপিবির প্রতিবেদন দেখা যায়, প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় সার্বিক রফতানি আয় কমেছে। এ খাত থেকে মোট আয়ের ৮১ শতাংশ আসলেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে নামমাত্র দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে নিট খাতে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ইভেনে কমেছে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। পোশাকের বাইরে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি থেকে আয় কমেছে দশমিক ৫৬ শতাংশ, চামড়ায় কমেছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর কৃষিপণ্যে কমেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, পোশাকের ওপর ভর করেই সার্বিক রফতানি বাড়ে। কিন্তু বৈশ্বিকভাবে পণ্যটির দাম কমে যাওয়া, শ্রমিক অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) চাপে ছোট ছোট অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে এ খাতে রফতানি কমেছে; যার ধাক্কা লেগেছে মোট রফতানিতে। তাই সবার উচিত তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ওষুধ, লাইটেনিং, পাট ও চামড়াজাতীয় পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের রফতানি বাড়ানো। তিনি বলেন, সরকারের উদ্যোগে একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ অনেক এগিয়েছে। প্রায় ২০টি অঞ্চলে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। বিদেশীদের এসব অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে বিনিয়োগ বাড়বে। প্রচলিত পণ্যসহ অপ্রচলিত পণ্যের বাজার প্রসারিত হবে। তবে বিদেশী বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত ও কর আদায়ের ব্যবস্থা সহজ করা দরকার। বিনিয়োগে তাদের আগ্রহী করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি রফতানি চাকাও সচল হবে বলে তিনি মনে করেন। ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিদেশে অবস্থিত রফতানি মিশনগুলো তাদের আয় বাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। অর্ধেকের বেশি মিশন তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। উপরন্তু কয়েকটির আয় গত বছরে অনেক বেশি কমেছে। দেশের প্রধান রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নয়াদিল্লী এবং সিঙ্গাপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশে অবস্থিত মিশন এই ব্যর্থতার তালিকায় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে রফতানিকারকদের সংগঠন ইএবির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, গতানুগতিক দেশের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না রফতানি খাত। নতুন নতুন দেশের দিকে ব্যবসায়িক পরিসর বাড়াতে হবে। মিশনগুলো এই কাজে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে পারে। বিশেষ করে কোন দেশে কখন কোন ধরনের পণ্যের উপযোগিতা ও চাহিদা রয়েছে, সেটা তারা খুঁজে বের করে সে মোতাবেক ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিতে পারে। তবেই সফলতা আসবে। তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোতে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমলেও বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টো চিত্র। এখানে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হচ্ছে। এছাড়া সেসব দেশের সরকার ব্যবসাবান্ধব নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী পোশাকের দর কমলেও তারা পুষিয়ে নিতে পারছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, ব্রেক্সিট ও সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলা তৈরি পোশাকের বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া দেশের বন্দরগুলোতে পণ্য বোঝাই জাহাজগুলোর দিনের পর দিন পড়ে থাকে পণ্য খালাস ও বোঝাই কোনটিই করতে পারছে না সময়মতো। ফলে মৌসুমে ক্রেতাদের পণ্য সরবরাহে বিঘœ ঘটছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, কারখানাগুলোতে গ্যাস সঙ্কট, স্থানান্তরিত ও নতুন কারখানায় বিদ্যুতের সংযোগ না দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এসব কারণে রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। তিনি বলেন, রফতানি বাড়াতে বাজেটে আগামী দুই বছরের জন্য তৈরি পোশাক খাতে নগদ প্রণোদনা দেয়ার অনুরোধ করা হলেও তা করা হয়নি। যে খাত থেকে সিংহভাগ রফতানি আয় আসে; সেখানে সঠিক নীতিগত সহায়তা না দিলে ভবিষ্যতে রফতানি প্রবৃদ্ধি আরও বড় ধরনের হোঁচট খেতে পারে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বৈশ্বিভাবেই রফতানি চিত্র খারাপ। যেমন ২০১৬ সালে ভারতে রফতানি আয় কমেছে ২ শতাংশ। আর চীনে সাড়ে ৭ ও শ্রীলঙ্কায় ১ শতাংশ কমেছে। এর কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে চাহিদা কমেছে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ। এর আগেও ২০১৪ সালের তুলনায় ১৫ সালে চাহিদা কমেছিল ৮ শতাংশ। তবে প্রতিযোগী কিছু দেশে রফতানি বেড়েছে। যেমন ভিয়েতনামে রফতানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এছাড়া কম্বোডিয়ায়ও বেড়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বৈশ্বিক মন্দায় আমরা রফতানিতে পেছালেও প্রতিযোগী দেশগুলো কিভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। কোন কোন পণ্য রফতানি করে তারা প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে; তা খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য রফতানিকারক, ইপিবি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাকের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য খাতের রফতানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরী। সেজন্য কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি কিন্তু উৎপাদন কম, কোথায় পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি, কোথায় দাম বেশিÑ এসব খুঁজে বের করতে হবে।
×