ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মার্শা বার্নিকাট

হলি আর্টিজান ॥ হামলার এক বছর

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৪ জুলাই ২০১৭

হলি আর্টিজান ॥ হামলার এক বছর

মাত্র এক বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঢাকা এবং বাংলাদেশের জন্য একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। হলি আর্টিজান বেকারিতে যে বর্বর আক্রমণের ঘটনা ঘটে যার পরিণতিতে পাঁচটি দেশের ২২ জন নির্দোষ মানুষ প্রাণ হারান আমি সেই ঘটনার কথাই বলছি। এই মানুষগুলো সেখানে গিয়েছিলেন শুধু একজন-আরেকজনের সান্নিধ্য এবং ঢাকার অন্যতম চমৎকার একটি রেস্তরাঁর খাবার উপভোগ করতে। এরকম একটি ব্যস্ততম জনবহুল স্থানে তাদের জীবনের এই অচিন্তনীয় পরিণতির ঘটনা বাংলাদেশী এবং বাংলাদেশের সমমনা বন্ধুদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। ওইদিন আমরা সকলেই বহু ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। জীবনের ভয়ঙ্কর এসব ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের ভেতর এই প্রশ্নটাও জেগেছিল যে এরপর কি আমরা নির্ভয়ে এই বৈচিত্র্যময় ও আনন্দপূর্ণ শহরটি উপভোগ করতে পারব কিনা। ওই সময়টিতে বাংলাদেশীরা যে সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেছে এর আগে এ দেশে এরকম সন্ত্রাসী হামলা কেউ দেখেনি। বাংলাদেশের খোলামেলা, অতিথিপরায়ণ এবং সহনশীল সংস্কৃতিতে বসবাসরত বিদেশী অতিথি হিসেবে আমরা আমাদের সরল বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছি যে আমরা কোন সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্য নই। এমনকি যেসব তরুণরা অত্যন্ত বর্বরভাবে যে হত্যাযজ্ঞ ঘটাল তারা যে ভাল পরিবার থেকে এসেছিল এবং উন্নতমানের শিক্ষা লাভ করেছিল এই বিষয়গুলো ওই মর্মান্তিক ঘটনাটিকে আরও বেশি অর্থহীন করে তুলল। সমাজের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা এসব তরুণরা হয়তো আর ১০-১৫ বছরের মধ্যে তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারত যদি না তারা নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নির্দোষ শিকারদেরও ধ্বংস না করে ফেলত। যখন পহেলা জুলাই এর বার্ষিকী আসছিল, এটা বলা সঠিক যে বাংলাদেশীরা এবং বিদেশী গোষ্ঠীরা এখনও তাদের দুঃখ ও কষ্ট এর সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এক বছর পর হামলার জায়গায় অনুষ্ঠিত হওয়া হৃদয়বিদারক স্মৃতি অনুষ্ঠান আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের ক্ষত এখনও শুকায়নি এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যারা হামলায় নিহত হয়েছে তারা এবং তাদের পরিবার ও বন্ধুরা ভুলে যাওয়ার নয়। যাদের আমরা হারিয়েছি তাদের স্মৃতি, আশা ও স্বপ্ন আমাদের ভাবনায় এবং প্রার্থনায় প্রাধান্য পাওয়া উচিত যখন আমরা এই হামলার শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। সম্ভব হলে আমি নিহত হওয়া প্রত্যেকের কথা ব্যক্তিগতভাবে বলতে চাইতাম। ব্যবসায়ী নেতা, শিক্ষার্থী এবং দাতা সংস্থার লোকজন সবাই ঢাকাতে ছিলেন। কারণ, তারা এখানে থাকতে চেয়েছিলেন, তারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করতেন। আমরা অনেকে তাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না কিন্তু নিহত ২২ জন নারী ও পুরুষের প্রত্যেকের অর্জন ও সম্ভাবনার অপূরণীয় ক্ষতি ও এই শোকের সময়ে আমরা সবাই একত্র হয়েছি। এই নিষ্ঠুরতা যা ভয় তৈরি করতে চেয়েছিল তার জবাবে বরং আমরা ওইদিন নিহতদের মধ্যে অন্যতম কনিষ্ঠ বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ফারাজ আইয়াজ হোসেন থেকে অনুপ্রেরণা নেই যাকে বন্দুকধারীরা ছেড়ে দেয়ার পরও সে তার বন্ধুদের সঙ্গে রয়ে যায় এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। এই রকম নিঃস্বার্থ একটি কাজ আমাদের চ্যালেঞ্জ করে নিজেকে প্রশ্ন করতে যে কিভাবে আমরা প্রতিদিনের হেনস্তা থেকে শুরু করে গৃহনির্যাতন, ক্ষমতার অপব্যবহারের উত্তর দেই। অকল্পনীয় ক্ষতি কীভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ শুভ সত্তাকে, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপ্রতি আব্রাহাম লিঙ্কন ‘বেটার এঞ্জেল’ বলেছেন, জাগ্রত করে সেটি একটি উদাহরণ থেকে বুঝতে পারি। সম্প্রতি আমার সুযোগ হয়েছিল হলি আর্টিজান আক্রমণে নিহত অবন্তি কবিরের মার প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল পরিদর্শনের। অবিন্তা একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ছিলেন। তার পরিবার তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশী শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে; তারা ধ্বংসের বিপরীতে সৃষ্টিকে বেছে নিয়েছেন, নেতিবাচকতা ও বিশৃঙ্খলার বিপরীতে তারা শিক্ষা ও সম্ভাবনাকে বেছে নিয়েছেন। এই কার্যক্রম অবিন্তার স্মৃতির প্রতি ও সেই সব ছেলেমেয়েদের জন্য, যারা তার দূরদৃষ্টি ও তার পরিবারের বদান্যতায় উপকৃত হচ্ছে, খুব সুন্দর ও স্থায়ী একটি উপহার। কাদামাটিতে জন্মেও পদ্মফুল অনিন্দ্য সুন্দরÑ এই রূপকটি এখানে যথার্থ। তেমনি হলি আর্টিজানের বিয়োগান্তক এই ঘটনা থেকেও বাংলাদেশীদের প্রিয় ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলো যেমন শান্তি, সহনশীলতা ও বহুমুখিতা ইত্যাদি আরও গভীরতর হচ্ছে। সেই রাতে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের সুন্দর জীবন নিয়ে আলোকপাতের পাশাপাশি তাদের, তাদের পরিবার ও বন্ধুদের জন্য রইল আমাদের প্রার্থনা। লেখক : ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত
×