ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

চ্যালেঞ্জের অর্থবছর ২০১৭-১৮

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ১৪ জুলাই ২০১৭

চ্যালেঞ্জের অর্থবছর ২০১৭-১৮

দৈনিক জনকণ্ঠের খবর ‘বন্যাকবলিত আট জেলায় ১২ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধানের ক্ষতি।’ শুধু জনকণ্ঠ নয় অনেক কাগজেই প্রতিদিন বন্যার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। খবর পড়ে মনে হয় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। একটি কাগজে বলা হয়েছে ‘বাড়ছে পানি সঙ্গে ভাঙন।’ খবরের ভেতরে বলা হয়েছে : ছয় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, পানিবন্দী কয়েক লাখ মানুষ, তিস্তা যমুনার গর্ভে বসতবাড়ি ফসলি জমি, ২ শিশুর মৃত্যু, ভারতে নজিরবিহীন বন্যার পূর্বাভাস, প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। এ ধরনের খারাপ খবর প্রতিদিন আমরা কাগজে পড়ছি। পড়ছি আর ভাবছি অর্থনীতির কী হবে, কী হবে নতুন বছরের অর্থনীতির। সবচেয়ে বড় কথা অর্থমন্ত্রীর জন্য এসব দারুণ খারাপ খবর। কারণ বন্যা মানেই ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি। বন্যা মানেই লাগবে ত্রাণ, সাহায্য সামগ্রী, চাল-গম, চিড়া-মুড়ি, শুকনো খাবার ইত্যাদি। এর অর্থই হচ্ছে লাগবে টাকা। এর অর্থ বাজেটের ওপর চাপ। কারণ সাধারণভাবে বাজেটে হঠাৎ বন্যার জন্য কোন বরাদ্দ থাকে না। বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হয় নতুন করে। অর্থমন্ত্রীর জন্য এটা খারাপ সংবাদ। এবার তো বটেই। তিনি ইতোমধ্যেই ভীষণ চাপে আছেন, চাপে আছেন রাজস্বের জন্য। তিনি বিশাল একটা বাজেট দিয়েছেন যার খরচের লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ কোটি টাকার বেশি। এত বড় বাজেট দিতে তিনি সাহস দেখিয়েছিলেন নতুন ভ্যাট আইনের ভরসা করে। তার ধারণা ছিল নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা গেলে এর মাধ্যমেই নেহাত রাজস্ব আসবে বিশ হাজার কোটি টাকা। এখন ‘নতুন ভ্যাট আইন’ আর বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দুই বছরের জন্য তা স্থগিত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। অতএব তার দুশ্চিন্তা এখন কীভাবে এই ২০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করবেন। তিনি এখন কিছুই বলতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবেন এত বড় ঘাটতি কীভাবে তিনি মেটাবেন। এই ঘাটতি ছাড়াও নানা কারণে আরও অনেক ঘাটতি ঘটে। সব মিলিয়ে ঘাটতি শেষ পর্যন্ত ২০ হাজার কোটি টাকার অনেক বেশি হতে পারে। এই যখন তার দুশ্চিতা, তখন হঠাৎ করে বন্যা এসে একটা ধাক্কা মেরেছে। নিশ্চিতভাবে এই বন্যা আমাদের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটকে আঘাত করে। নিশ্চিতভাবে আমাদের অর্থনীতিকে বন্যা আঘাত করবে। অতএব দুশ্চিন্তা বেড়েছে বৈ কমেনি। বলাবাহুল্য দুশ্চিন্তা আরও অনেক ক্ষেত্রেই আছে। অর্থমন্ত্রী, আমি নিশ্চিত, এসব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। বন্যা দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে। তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালের জানুয়ারি-মার্চে মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ, সেখানে এপ্রিল-জুন সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। বলাবাহুল্য খাদ্য মূল্যের মূল্য বৃদ্ধিই এ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। নতুনভাবে মূল্যস্ফীতির খবর অর্থমন্ত্রীকে ভাবিয়ে তুলবে বলে আমার ধারণা। বস্তুত ২০১৭-১৮ অর্থবছরটি শুরু হয়েছে অনেক খারাপ খবর দিয়ে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাই হবে এবার তার প্রধান কাজ। এদিকে খবর হচ্ছে ‘কারেন্ট এ্যাকাউন্টে’ ঘাটতি বৃদ্ধির দিকে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে এই ঘাটতি ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর কারণ দুটো। রফতানির পরিমাণ আগের মতো বাড়ছে না। বিপরীতে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাও অর্থমন্ত্রীর জন্য খারাপ খবর। কারণ ‘কারও এ্যাকাউন্টে’ ঘাটতি শেষ পর্যন্ত ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টে’র ঘাটতিতে পরিণত হলে দুঃখের সীমা থাকবে না। এই দুশ্চিন্তাও দিন দিন বাড়ছে বাড়ানির তথ্য দেখে। রফতানি বাড়ছে, কিন্তু এর পরিমাণ যৎসামান্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বছরের শুরুতে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন বাস্তবচিত্র ভিন্ন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র এক দশমিক ৬৯ শতাংশ হারে। অথচ গেল অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়েছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ হারে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৪ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন (শত কোটি) ডলার। তথ্যে দেখা যাচ্ছে গত ১৫ বছরের মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরেই রফতানি বৃদ্ধির পরিমাণ সবচেয়ে কম। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের রফতানি হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি বাণিজ্য সমতা। তারা এখন তাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চায়। তারা বলছে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি পণ্য আমদানি করতে হবে। এটা নতুন একটা চাপ। এছাড়া অন্যান্য বাজারের চিত্রও সুখকর নয়। অথচ তৈরি পোশাক হচ্ছে রফতানি খাতের ‘প্রাণভোমরা’। এমনকি তা আমাদের অর্থনীতির প্রধানতম স্তম্ভ। আরেকটি স্তম্ভ রেমিটেন্স। নতুন অর্থবছরে এই খাতও অর্থমন্ত্রীকে দুশ্চিতায় ফেলবে। কয়েকদিন আগে একটি খবরে দেখলাম সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, বাহরাইন ও সিঙ্গাপুর ইত্যাদি প্রধান প্রধান দেশ থেকে রেমিটেন্স ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বস্তত রেমিটেন্স গত কয়েক বছর ধরেই নিম্নমুখী। ক্রমহ্রাসমান প্রবণতার ওপর অনেক লেখালেখি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা নানা রকমের কারণের কথা আমাদের জানাচ্ছে। এর মধ্যে হুন্ডিকেই বেশি দায়ী করা হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘ওয়েজ আর্নাররা’ বিদেশেই ‘ডলার’ জমিয়ে রাখছে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ সেখানকার অভিবাসন জটিলতা। কারণ যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে রেমিটেন্স হ্রাস পাচ্ছে। একে তো রফতানি আগের মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে না, তার ওপর ক্রমাগতভাবে রেমিটেন্স হ্রাস নিশ্চিতভাবেই অর্থমন্ত্রীর জন্য বিশাল চাপের সৃষ্টি করবে। এদিকে ‘এসডিজি’ (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) সম্পর্কিত খবরও খারাপ। ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনে বিশেষ সাফল্য অর্জনের পর আমরা খুব আশাবাদী ছিলাম ‘টেক্সই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে। কিন্তু সর্বশেষ খবরে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০টি আসন লাভ করেছে। জাতিসংঘের খবরে দেখা যাচ্ছে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই ১০টিতেই আমরা ‘লাল’ ক্যাটাগরিতে। এটা কী ‘আত্মতুষ্টির’ ফল? এটা কী আমলাদের অকর্মন্যতার ফল? না, অন্য কারণ আছে? আমার ধারণা নেই। তবে দুই বছরের বর্তমান পারফরম্যান্স কোন মতেই মেনে নেয়া যায় না। আরেকটি খবর ‘গভীর সমুদ্রবন্দর’ নিয়ে। ‘কনটেইনারশিপ অপারেটরদের’ প্রধান এসএসটিও বলছেন ‘গভীর সমুদ্রবন্দর’ অর্থনৈতিকভাবে লাভপ্রদ নাও হতে পারে। অথচ এটি আমাদের ‘ড্রিম প্রজেক্ট’। কী ঘটল যে টিও সাহেব হঠাৎ করে এ কথা বলছেন। উল্লেখ্য, এসব খারাপ খবর নিয়েই এবারের যাত্রা শুরু। আমি দুঃখিত এসব খবরের ওপর আমাকে লিখতে হলো। আমি চাই সব সময়ই ভাল খবর। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরটি কেন জানি প্রত্যাশানুযায়ী শুরু হয়নি। তার অর্থ সব শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের সাবধানতা অবলম্বনের সময় এখন। চ্যালেঞ্জ বহুমুখী। একটু ভুল করলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। অতএব মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরতে বলব। আশা করা যায় সাময়িক এই দুর্বলতাগুলো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×