ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উৎসবের আমেজ ব্যাঙ রাজ্যে

ভরা বর্ষায় নব যৌবনা রাতভর ডাকাডাকি প্রণয় সম্ভাষণ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৩ জুলাই ২০১৭

ভরা বর্ষায় নব যৌবনা রাতভর ডাকাডাকি প্রণয় সম্ভাষণ

মোরসালিন মিজান ॥ গ্রামেও ব্যাঙ নেই। কত ছিল এক সময়! এখন সে তুলনায় অনেক কম। অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। তবে ভরা বর্ষায় এরা নতুন প্রাণ পেয়েছে। এই প্রাণের স্পন্ধন শোনা যাচ্ছে এমনকি রাজধানী শহর ঢাকায়। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায়, যেখানে বৃষ্টির জল জমে আছে, ব্যাঙ বাসা বাড়ি করেছে সেখানে! টানা বর্ষণ আর আকাশের মেঘ গুড় গুড় শব্দ এদের শান্ত থাকতে দিচ্ছে না। চিত্তচাঞ্চল্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। উৎসবে মেতেছে খুব চেনা উভচর প্রাণী। গত কয়েকদিন মতিঝিল মানিকনগর শনিরআখড়াসহ বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নানা জাতের ব্যাঙ। মতিঝিলের কয়েকটি কলোনির সামনে খোলা মাঠ। মাঠের যে অংশে জল জমে আছে, সে অংশটিকে নিজেদের করে নিয়েছে ব্যাঙ। মঙ্গলবার রাত ১২টার পর সেখানে গিয়ে মনে হচ্ছিল অজপাড়া গাঁ! দূর থেকে ব্যাঙের ডাকাডাকি কানে আসছিল। একটি ব্যাঙ ডাকা শেষ করলে শুরু করছিল অন্যটি। এভাবে লম্বা সময়। আর যখন চুপ হয়ে যায় তখন একদমই চুপ। সেখানে ব্যাঙের কোন অস্তিত্ব আছে বলেই মনে হয় না। ব্যাঙের ডাকাডাকির শব্দ অনুসরণ করে কাছে গিয়ে দেখা যায়, ২ থেকে ৩টির মতো ব্যাঙ। পরক্ষণেই মনে হয়, ৫টি। তার পর ৭টি। আসলে ছোটাছুটির কারণে ওদের ঠিকমতো গোনা সম্ভব হচ্ছিল না। আফতাব নগরের শূন্য প্লটগুলোতেও জল জমে আছে। সেখান থেকেও নিত্য ভেসে আসছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দ। রাতের বেলায় মোবাইল ফোনের আলো ফেলতেই দেখা গেল, কয়েক জোড়া ব্যাঙ। জোড়া বলেই মনে হয়েছিল প্রথম। পরে লক্ষ্য করে দেখা গেল, একটি ব্যাঙ। অন্যটি জলের ওপর পড়া প্রতিবিম্ভ! এবার একটু তথ্য ঘেঁটে দেখা যাক। বাংলাদেশের ৫৪ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মধ্যে ব্যাঙ অন্যতম। প্রধানতমও বলা যায়। এ্যানিউরা বর্গের মেরুদ-ী প্রাণীটিকে স্থলভাগে কম বেশি সারা বছর দেখা যায়। মূল আবাস জলে। বর্ষায় ডোবা নালা খাল বিল ভরে উঠলে উৎসব শুরু হয়ে যায় ব্যাঙের। শুধু তাই নয়, এখন প্রজনন মৌসুম। স্ত্রী পুরুষ একে অন্যের কাছাকাছি আসতে ব্যাকুল। অহর্নিশ ডাকাডাকি এ কারণেই। মূলত প্রণয় সম্ভাষণ! নিশাচর প্রাণী খাবার সংগ্রহসহ অন্য অনেক কাজ রাতে করে। রাতেই বেশি টের পাওয়া যায় অস্তিত্ব। তবে ব্যাঙের জাত পাত বোঝা সাধারণের পক্ষে একটু কঠিন। বিষয়টির ওপর অত বেশি গবেষণা নেই। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন কিছু কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের গবেষণা থেকে বেশকিছু ব্যাঙের নাম পরিচয় পাওয়া যায়। যেমনÑ কোলা ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, সবুজ ব্যাঙ, ঝিঁ ঝিঁ ব্যাঙ, কটকটি ব্যাঙ, চীনা ব্যাঙ, বড় লাউবিচি ব্যাঙ, কোপের আসাম ব্যাঙ, ভামো ব্যাঙ, ডোরা গেছোব্যাঙ, লাল চোখা ব্যাঙ, লাল পা গেছো ব্যাঙ। আরও কত কত নাম! বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিশেষ চেনা জানা কুনো ব্যাঙ। বাড়ির আশপাশে থাকে। মাটির ঘরের মেঝে ও অন্ধকার কোণ এদের পছন্দ। দিনে চুপটি করে বসে কাটায়। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পরলে সরব হয়। কুনো ব্যাঙের উপরের অংশ বাদামী। ত্বক খসখসে। আঁচিলযুক্ত। পেটের দিকটা সাদা দেখতে। মাথা তুলনামূলক বড় ও চওড়া। স্ত্রী ব্যাঙ পুরুষের তুলনায় মোটা। এরা বেশিরভাগ সময়ই ডাঙায়। গড় আয়ু চার বছর। কোলা ব্যাঙও বেশ পরিচিত। এটিকে সোনা ব্যাঙ নামে ডাকা হয়। আকারে কোলা ব্যাঙ দেশের সবচেয়ে বড়। গায়ের রং ধূসর বাদামী কিংবা হলুদ। পায়ের গড়ন শক্ত হওয়ায় জলে ও স্থলে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে। কিছু ব্যাঙ বাড়তি সৌন্দর্যের কারণে নজর কাড়ে। যেমনÑ সবুজ ব্যাঙ। গাঢ় সবুজ রঙের বলেই সবুজ ব্যাঙ নাম। জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে গায়ের রং মিলেমিশে যায়। তাই সহজে চোখে পড়ে না। সবুজ ব্যাঙের মাথা চ্যাপ্টা। চোখ মাথার বেশ কাছাকাছি দূরত্বে থাকে। এদের নাকের অগ্রভাগ থেকে একটি হলদে রেখা পিঠের মাঝ দিয়ে শরীরের শেষ ভাগ পর্যন্ত চলে গেছে। জীবনের বেশিরভাগ সময় পানিতে কাটায়। ঝিঁ ঝিঁ ব্যাঙ বাসা বাড়ি, ধানক্ষেত ও এর আশপাশে দেখা যায়। ভেজা মাটি বা অল্প পানিযুক্ত স্থানে থাকে। গায়ের রং ধূসর বাদামী। পিঠে আঁচিলযুক্ত। মাঝে মাঝে হালকা সবুজের ছোপ থাকে। ঝিঁ ঝিঁ ব্যাঙ আবার দিন রাত উভয় সময়ই চলাচল করে। ব্যাঙের অদ্ভুত আরেকটি নাম কটকটি। এই ব্যাঙ দেশের সর্বত্রই দেখা যায়। সাধারণত ডোবা নালা খাল বিলে ভাসমান অবস্থায় থাকে। জীবনের পুরো সময় পানিতে কাটায়। গায়ের রং বাদামী কিংবা ধূসর। দেহে ছোট ছোট আচিল। এটিও দিন ও রাতে সমান কর্মচঞ্চল। বর্ষকালে ঝাঁক বেধে চলে। চীনা ব্যাঙ দেখতে লালচে কিংবা ধূসর জলপাই রঙের। দুই চোখের মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুরু হয়ে একটা কালচে রেখা দেহের পেছনের দিকে চলে গেছে। দেহ মসৃণ ত্বক দ্বারা আবৃত। পেটের দিক হলদে সাদা। চীনা ব্যাঙ লম্বায় প্রায় ২৫ মিলিমিটার। সাধারণত স্যাঁতসেঁতে জমি, ভেজা ঘাস, পাতার স্তূপ এবং জলাধারের নিকটবর্তী জায়গায় বিচরণ করে। ফাউন্ডেশনের গবেষণা মতে, বড় লাউবিচি ব্যাঙ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মিশ্র চিরসবুজ বন এবং শালবনে দেখা যায়। এরা দেখতে লালচে বাদামী রঙের হয়। দেহের দুই পাশে কালো রঙের ছোপ ছোপ দাগ থাকে। দেহের দৈর্ঘ ৩০ থেকে ৪৫ মিলিমিটার। সাধারণত গর্তে থাকতে পছন্দ করে। পাহাড়ী ছড়ার ধারে কিংবা পানিতেও বিচরণ করে। কোপের আসাম ব্যাঙ শালবন ও পাহাড়ী চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। মানব বসতির আশপাশে দেখা যায় না। এরা দেখতে গাঢ় বাদামী রঙের। পিঠে বিন্দু বিন্দু কালো দাগ থাকে। দিনের বেলায় জলাশয় কিংবা জলাশয়ের আশপাশের সিক্ত জায়গায় অবস্থান নেয়। খড়খুটোর আড়ালে থাকে। সন্ধ্যার পর খাবারের সন্ধানে বের হয়। দুর্লভ ব্যাঙগুলোর মধ্যে বলতে হয় ভামো ব্যাঙের কথা। চিরসবুজ বনে অল্প সংখ্যায় দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৮০ মিলিমিটার। পিঠের রং উজ্জ্বল সবুজ। কিংবা জলপাই রঙের হয়। পেটের দিক সাদা। পিঠের দুই পাশে চোখের পেছন থেকে দেহের পশ্চাৎ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বালম্বি সোনালি রঙের দুটি ভাঁজ দেখা যায়। চোখের পেছনে বেশ বড় আকারের টিম্পেনাম রয়েছে যা শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাজ করে। ডোরা গেছো ব্যাঙ গাছেই থাকে। গায়ের রং হলদে বাদামী। পিঠের ওপরে হালকা কালো রঙের তিনটি ডোরা সহজে চোখে পড়ে। দেহ বেশ সরু। লাল চোখা ব্যাঙের চোখের ওপরের অংশ গাঢ় কমলা বা লাল রঙের হয়। পাহাড়ী অঞ্চলের ছড়ায় দেখা যায়। দেহ ধূসর কিংবা কালচে। লাল পা গেছো ব্যাঙ দেখতে জলপাই সবুজ। পেটের দিকটা হলুদ। তবে বিচিত্র এই ব্যাঙরাজ্যের খুব অল্পই দেখা যায় এখন। হাতেগোনা কয়েকটি জাত কোন রকমে টিকে আছে। বাকিগুলো নিশ্চিহ্ন। বর্ণমালা শেখার বইতে আশ্রয় নিয়েছে ব্যাঙ। ‘ঙ’ বর্ণটি শেখাতে শিশু কিশোরদের আগেও ব্যাঙের ছবি দেখানো হতো। এখন ওটাই হয়ে গেছে একমাত্র!
×