ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘সেবাদাসী’ অর্চনা রানী জবানবন্দীতে যা বললেন-

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৩ জুলাই ২০১৭

‘সেবাদাসী’ অর্চনা রানী জবানবন্দীতে যা বললেন-

শংকর কুমার দে ॥ কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার অপহরণের সাজানো নাটকের ঘটনার বিষয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছেন অর্চনা রানী নামে এক নারী। অপহরণের ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে অর্চনা রানী নামে এই নারীর অসম পরকিয়ার কাহিনী। তার নিজের মুখের জবানবন্দীতে অর্চনা রানী যা বলেছেন তা চোখ কপালে উঠার মতো ঘটনা। জবানবন্দীতে অর্চনা রানী বলেছেন তাকে ‘দীক্ষা’ দেন ফরহাদ মজহার। তিনি ‘ফকির ও বৈষ্ণব আদর্শে দীক্ষা দেন তাকে। ফরহাদ মজহারের কাছে দীক্ষা নেয়ার পর ‘সেবাদাসী’ হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন এই নারী। জবানবন্দীতে এ ধরনের কথা বলেছেন অর্চনা রানী। ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের কাছে ১৬৪ ধারায় ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তাদের কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন অর্চনা। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। অর্চনা জবানবন্দীতে বলেছেন, ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনীগ-এ চাকরি পাওয়ার পর টাঙ্গাইলে পনেরো দিনের ট্রেনিং নিয়ে কক্সবাজার ব্রাঞ্চে যোগদান করি। কক্সবাজার উবিনীগ-এ চাকরি করাকালে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ফরহাদ মজহারের ভক্ত হই। তার কাছ থেকে দীক্ষা নেই। তারপর তাকে গুরু বাবা বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে ফকির ও বৈষ্ণব আদর্শে অনুপ্রাণিত করেন। আমি তার সেবাদাসী হিসেবে আত্মনিয়োগ করি। এরপর আমি ঈশ্বরদীতে বদলি হয়ে যাই। ঈশ্বরদীতে থাকাকালে গুরু বাবার সঙ্গে আমার দৈহিক সম্পর্ক হয়। মাসে দু’একবার তিনি ঈশ্বরদীতে আসতেন। ঈশ্বরদীতে আসলে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক হতো। এরপর আমারে টাঙ্গাইলে বদলি করা হয়। বদলি হওয়ার পর আমি টাঙ্গাইল চলে আসি। জবানবন্দীতে অর্চনা বলেছেন, গুরু বাবা মাসে মাসে টাঙ্গাইল আসত। আমার সঙ্গে টাঙ্গাইলে দৈহিক সম্পর্ক হতো। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আকতার আমার গুরু বাবার সঙ্গে সম্পর্ক বুঝতে পারে। আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেয়। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে আমার মোবাইল যোগাযোগ হতো। এরপর বর্তমান বাসায় গুরু বাবা মাঝে মাঝে আসত। আমার বর্তমান পশ্চিম নূরের চালার বাসায় খাওয়া দাওয়াসহ দৈহিক মেলা মেশা করত। গুরু বাবা মাঝে মাঝে আমার প্রয়োজন মোতাবেক ১০-১২ হাজার করে টাকা দিত। অসুখ বিসুখ হলে বেশি টাকা দিত। অর্চনা তার জবানবন্দীতে বলেন, প্রায় দুই বছর আগে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। গুরু বাবার পরামর্শ মতো আমি মালিবাগের একটি ক্লিনিকে গোপনে গর্ভপাত ঘটাই। সমস্ত টাকা আমার গুরু বাবা ফরহাদ মজহার পরিশোধ করেছিল। আমি সুস্থ হওয়ার পর মাঝে মাঝে গুরু বাবার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক হতো। আমি ভাটারা এলাকায় টিফিন ক্যারিয়ারে সরবরাহ করেও টাকা আয় করতাম। অর্চনা রানী জবানবন্দীতে বলেন, ১৬/০৪/২০১৭ ইং তারিখে আমি আবার গর্ভবতী হয়ে পড়লে গুরু বাবার কাছে টাকা চাই। গুরু বাবার কাছে টাকা না থাকায় তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। ০৩/০৭/২০১৭ তারিখ সকাল ৬-২০ ঘটিকায় গুরু বাবা ফোন করে আমাকে জানায় তোমার টাকা সংগ্রহের জন্য বাইরে বের হয়েছি, চিন্তা করো না। ০৩/০৭/২০১৭ সালে সকাল ১১টায় আমি গুরু বাবাকে মোবাইল ফোনে জিজ্ঞাসা করি আপনি অপহৃত হয়েছেন কিনা? তিনি আমাকে ফোনে বলে কোন সমস্যা নেই। আমি ভাল আছি। এরপর সন্ধ্যা ৭ ঘটিকার দিকে গুরু বাবা আমাকে মোবাইল করে। একটি এ্যাকাউন্ট নাম্বার চাই। কিছু টাকা পাঠাতে চাই। তখন আমি তাকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট নাম্বার পাঠাই। আমাকে দুইটি নাম্বার হতে ১৫ হাজার টাকা পাঠায়। আমার কাছে জিজ্ঞাসা করে টাকা পেয়েছি কিনা? আমি আবার মোবাইল চেক করে বলি টাকা আসার কথা জানি না। পুনরায় সে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে আমি টাকা পেয়েছি কিনা? তিনি কথা বলার পর ফোন কেটে দেয়। ০২/০৭/২০১৭ তারিখে গুরু বাবা ৫-৬ বার ফোন করেছে। আমি ২-৩ বার ফোন করি। আমি ০৪/০৭/২০১৭ তারিখে বিকেল ৬ ঘটিকায় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আমার আত্মীয় রবি সমাদ্দারের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাই। ০৯/০৭/২০১৭ তারিখে ডিবি আমাকে রাঙ্গুনিয়া থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বুধবার বলেন, ‘এই অপহরণ নিয়ে অত্যন্ত রহস্য তৈরি হয়েছে। কারণ ফরহাদ মজহার সাহেব বিজ্ঞ আদালতে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যে ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি, সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছি, কল লিস্ট পেয়েছি, বস্তুগত সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছি, তার সঙ্গে উনার বক্তব্যের মিল নেই।’ তিনি বলেন, ‘কংক্রিট সিদ্ধান্তে আসার জন্য আমাদের আরও দু-একদিন সময় লাগবে। দু-একদিন পর সংবাদ সম্মেলন করে এই নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনায় গত নয় দিনের তদন্তে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, সে সবের বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। পুলিশের পক্ষ থেকে শীঘ্রই এ নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। গত ৩ জুলাই ভোরে ঢাকার শ্যামলীর রিং রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে ডানপন্থী অধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত কবি প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার ‘অপহৃত’ হন বলে তার পরিবারের অভিযোগ। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে অনুসন্ধান শুরু করে এবং রাতে যশোরে হানিফ এন্টারপ্রাইজের একটি বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের কথা জানানো হয়। ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার আদাবর থানায় যে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন, পরে তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে পুলিশ। এরপর ফরহাদ মজহার অপহরণের মামলাটির তদন্তের ভার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) দেয়া হয়। ডিবি পুলিশ ঢাকায় নিয়ে আসার পর ফরহাদ মজহারকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তিনি হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় বিচারিক জবানবন্দী দেন। জিজ্ঞাসাবাদে ফরহাদ মজহার বলেছিলেন, সোমবার ভোরে ওষুধ কেনার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। মামলায় বলা হয়, ফরহাদ মজহার তার ফোন থেকে স্ত্রীকে পাঁচবার কল করে বলেন, অপহরণকারীরা ৩৫ লাখ টাকা চেয়েছে। ওইদিন রাতে যশোরের বাসে ফরহাদ মজহারের খোঁজ পাওয়ার আগে খুলনা নিউ মার্কেট এলাকার ‘নিউ গ্রীল হাউস’র মালিক আব্দুল মান্নান দাবি করেন, তার রেস্তরাঁয় ফরহাদ মজহার ভাত খেয়েছেন। পরে টিভিতে ফরহাদ মজহারের ছবি দেখে তিনি র‌্যাবকে খবর দিলে রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের নওয়াপাড়ায় খুলনা থেকে ঢাকাগামী একটি বাস থামিয়ে শেষের সারির আসনে ফরহাদ মজহারকে পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ফরহাদ মজহারের প্রতিষ্ঠান উবিনীগের সাবেক নারী কর্মী অর্চনা রানী পুলিশ সোমবার ঢাকার আদালতে হাজির করে এবং তিনিও হাকিমের কাছে জবানবন্দী দেন।
×