ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ পাচার রোধে তথ্য বিনিময় চুক্তি হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৩ জুলাই ২০১৭

অর্থ পাচার রোধে তথ্য বিনিময় চুক্তি হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে

এম শাহজাহান ॥ দেশ থেকে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে তথ্য বিনিময় চুক্তি করা হতে পারে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা বাড়া না বাড়া নিয়ে সংসদ ও সংসদের বাইরে তুমুল বিতর্কের পর সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ৩৮টি দেশের তথ্য বিনিময় চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তির আওতায় আগামী বছর থেকে ওই দেশগুলো সুইস ব্যাংকগুলোতে তাদের নাগরিকদের লেনদেনের যাবতীয় তথ্য পাবে। এছাড়া ‘মাল্টিলেটারাল কম্পিটেন্ট অথরিটি এগ্রিমেন্টে’র আওতায় বিশ্বের আরও ৪১টি দেশের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের প্রক্রিয়া সুইস ফেডারেল কাউন্সিলে গৃহীত হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্থ পাচার রোধ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধে বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, বাংলাদেশের টাকা রাখার তথ্য চেয়ে গত কয়েক বছরে সুইস ব্যাংকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে এ ধরনের কোন চুক্তি না থাকায় সংস্থাটি কোন তথ্য দিচ্ছে না। এছাড়া দেশটির ব্যাংকিং আইন ১৯৩৪ অনুযায়ী কোন ব্যক্তির এ্যাকাউন্টের হিসাব অন্যকে প্রদান করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। সুইজারল্যান্ডের ফিন্যান্সসিয়াল মার্কেট সুপারভাইজার অথরিটি এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে। মূলত মধ্যযুগ থেকে সুইজারল্যান্ডে এমন মূল্যবোধ প্রচলিত। ফলে কোন ধরনের চুক্তি ছাড়া দেশটি থেকে কোন ধরনের তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ফিন্যান্সসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং সুইজারল্যান্ডের ফিন্যান্সসিয়াল ইউনিট এগমন গ্রুপের সদস্য। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন (ইএনসিএসি) স্বাক্ষরকারী দেশ। ফলে এই দুইদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা ও মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স চুক্তি স্বাক্ষর হলে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, চুক্তির আওতায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে পাচার হওয়া অর্থের তথ্য দিতে সম্মত হয়েছে সুইস ব্যাংক। এ বিষয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারের সঙ্গে চার বছরের একটি চুক্তি করেছে ভারত। ফলে ভারতের অর্থ পাচারকারীদের ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থ পাচার ঠেকাতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে তথ্য বিনিময় চুক্তি করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা হচ্ছে। এ বিষয়ে দেশটির সঙ্গে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে। তিনি বলেন, রক্ষণশীলতার নীতি থেকে সরে এসে সুইজারল্যান্ড এখন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তথ্য বিনিময় চুক্তি করছে। আমাদের সঙ্গেও করবে। ইতোমধ্যে দেশটির রাষ্ট্রদূত এ ধরনের চুক্তি করার জন্য বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, চুক্তির আওতায় যেহেতু ভারতের তথ্য দিতে সম্মত হয়েছে সুইস সরকার, সেহেতু আমরা প্রত্যাশা করি আমাদেরও তথ্য দেয়ার ব্যাপারে দ্রুত ইতিবাচক অগ্রগতি হবে। এদিকে ব্যক্তির অর্থে নয়, বিভিন্ন ব্যাংকের জমা রাখা টাকার কারণেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের সম্পদ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সুইজারল্যান্ডের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টিয়ান ফশ। সম্প্রতি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে সুইস রাষ্ট্রদূত ওই তথ্য জানান। ওই সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, বিভিন্ন আর্থিক ইনস্ট্রুমেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর সঞ্চিতি বৃদ্ধির কারণেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের সম্পদ বেড়েছে। জানা গেছে, ব্যাংক গ্রাহকদের তথ্যের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষার যে নীতি সুইজারল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বজায় রেখে আসছিল তা সম্প্রতি শিথিল করা হচ্ছে। কালোটাকা ও অর্থ পাচার রোধে ২০১৭ সালে সুইজারল্যান্ড ৩৮টি দেশের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের চুক্তি করে, যার আওতায় আগামী বছর থেকে ওই দেশগুলো সুইস ব্যাংকগুলোতে তাদের নাগরিকদের লেনদেনের তথ্য পাবে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সব সদস্য দেশ, জিব্রালটার, অস্ট্রেলিয়া, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, জাপান, কানাডা ও দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে ওই ৩৮ দেশের মধ্যে। এছাড়া মাল্টিলেটারাল কম্পিটেন্ট অথরিটি এগ্রিমেন্টের আওতায় আরও ৪১টি দেশের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের প্রক্রিয়া সুইস ফেডারেল কাউন্সিলে গৃহীত হয়েছে। আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে বাংলাদেশও এ ধরনের চুক্তি করার জন্য সুইজারল্যান্ড সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিদায়ী রাষ্ট্রদূত। এদিকে সংসদে বলার পর এবার সাংবাদিকদেরও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানালেন, আমি গতকাল যে স্টেটমেন্ট দিয়েছি তাতে এটা প্রমাণিত হয়- আমাদের খুব বেশি লোকের টাকা সুইস ব্যাংকে নাই। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী অর্থ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নো নো কোন অর্থ বাড়েনি, কমেছে। বরং স্টেটমেন্টে বলেছি যে, গত বছরের চেয়ে অর্থের পরিমাণ কমেছে। বুধবার সচিবালয়ে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাবার কালে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। এর আগে মঙ্গলবার সংসদে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো বাংলাদেশীদের অর্থ নিয়ে স্টেটমেন্ট দেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের এবং সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব হয় সেটি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বাস্তবে এটি মোটেই অর্থ পাচার নয়। এসব হিসাবে ব্যক্তিখাতে অনেক বাংলাদেশী নাগরিক আছেন যারা বিদেশে কাজ করেন অথবা স্থায়ীভাবে অবস্থান করেন। তাদের হিসাবও এটা অন্তর্ভুক্ত আছে। সে হিসাবটি দেয়া যাচ্ছে না। কেননা যেসব বাংলাদেশী তাদের পাসপোর্টকে পরিচয় চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাদের সংখ্যা আমাদের জানা নেই। এতে প্রতিপন্ন হয়, টাকা পাচারের বিষয়টি মোটেই তেমন কিছু নয়। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, বিদেশে অর্থ যে পাচার হয় না সে কথা আমি বলব না। কিন্তু এইসব সংবাদ মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলে বলা হয়েছে, সেটা বাস্তবেই অতিশয়োক্তি বলে বিবেচনা করা বলা চলে। তিনি বলেন, আপনারা জানেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মোটামুটিভাবে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সুইজারল্যান্ডেও আমাদের যথেষ্ট লেনদেন আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। প্রসঙ্গত সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা টাকার পরিমাণ এক বছরে ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৬’ বলছে, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের জমা অর্থের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৫৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় হিসাব করলে ৫,৫০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ বাংলাদেশীরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা করেছেন। এর মধ্যে ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালে জমার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা সম্প্রতি জানান, সুইস ব্যাংক কিভাবে রিপোর্ট তৈরি করেছে তা আমার জানা নেই। তবে টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় কাজ করছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
×