ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উত্তরের পানি নেমে আসছে মধ্যাঞ্চলে;###;প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন অঞ্চল

বাড়ছে বন্যা কবলিত এলাকা ॥ দুর্ভোগে মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৩ জুলাই ২০১৭

বাড়ছে বন্যা কবলিত এলাকা ॥ দুর্ভোগে মানুষ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বানভাসি এলাকায় মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই। প্রতিদিন বেড়েই চলেছে বন্যার পানি। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টিপাত। উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাত যোগ হয়ে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনিত ঘটাচ্ছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা উত্তরের বন্যা পরিস্থিতির পাশাপাশি দেশের মধ্যাঞ্চলেও বন্যার আশঙ্কা করছেন। তারা বলেন, উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে নেমে এলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হবে। এদিকে নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে পড়ছে অনেক বসতবাড়ি। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে অনেক মানুষ। এ অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ড খবর দিয়েছে, দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তারা জানায়, দেশের ৮টি প্রধান নদী সমতলে ১২ টি স্টেশনে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে বাহাদুরাবাদঘাট এলাকায় যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ ও কাজীপুরে এ নদীর পানি ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের অব্যাহত ভারি বৃষ্টিপাত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাত বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে এক রাতে ঢাকায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত রাজধানীতে এই পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া তারা জানায়, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার পর্যন্ত ঢাকায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১০৩ মিলিমিটার; যা ওইদিন দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। তারা জানায়, ঢাকার পরে দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে রাজশাহীতে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহীতে ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ময়মনসিংহে ২৮, সিলেটে ১৯, চট্টগ্রামে ৫, খুলনায় ৬, বরিশালে ৬ ও রংপুরে ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, বৃষ্টির এই ধারা আরও তিনদিন অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগের কোন সীমা নেই। বন্যার অবনতির কারণে কুড়িগ্রামে সাড়ে তিনলাখ লোক পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। গাইবান্ধরায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে আরও ৯৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী মানুষ নিরাপদে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টার করছে। পাশিপাশি ত্রাণের জন্যও ছুটছেন তারা। জানা গেছে বন্যায় সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বনার্ত এলাকায় খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। পানি ওঠায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে শিক্ষার্থীরাও পড়েছে বিপাকে। কুড়িগ্রাম॥ সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। হু হু করে বাড়ছে নদ-নদীর পানি। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে দুধকুমোর নদীর পানি ৫ সেমি এবং তিস্তার পানি ১১ সেমি বাড়লেও বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে তিন লক্ষাধিক মানুষ। ৭ দিন থেকে পানিবন্দী অবস্থায় চরম খাদ্যকষ্টে পড়েছে পানিবন্দী মানুষ। ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবার, জ¦ালানি, খাদ্য সঙ্কট। কৃষকরা গবাদিপশু নিয়েও পড়েছে চরম সঙ্কটে। কারণ গোখাদ্যের তীব্র সঙ্কট বিরাজ করছে। সরকার যে ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আবার বরাদ্দ যা পাওয়া যাচ্ছে তা মাঠ পর্যায়ে বিতরণ হচ্ছে ঢিলেঢালা ভাবে। ফলে বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে। বন্যার কারণ ১শ’ ৪৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। গাইবান্ধা ॥ গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির বুধবার আরও অবনতি হয়েছে। বন্যার পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় ৪ উপজেলার ৯৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ফলে বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবন্দী পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। তাদের বিশুদ্ধ পানি, জ্বালানি ও শুকনা খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২৩টি ইউনিয়নের নদীবেষ্টিত অঞ্চল ও চরাঞ্চলের ঘরবাড়ি, ফসল তলিয়ে গেছে। এতে ৭০ হাজার ৯শ’ ২৯টি পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার বিকেল থেকে সাবেক ফুলছড়ি উপজেলা হেডকোয়ার্টারে পানি উঠেছে। ফলে ওই বন্দরে চলাচলের এখন বাহন হয়ে পড়েছে নৌকা। নৌকায় সেখানে কেনাকাটার জন্য যাতায়াত করছে। এছাড়া ভরতখালী থেকে ফুলছড়ি বন্দরে যাওয়ার রাস্তাটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লোকজনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যাকবলিত ৪ উপজেলায় ৮২টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এরমধ্যে ১৭টিতে বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। টাঙ্গাইল॥ যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি ধলেশ্বরী নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নদী দুটির পানি বুধবার সকালে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব এলাকার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে টাঙ্গাইল সদর, গোপালপুর, ভূঞাপুর ও কালিহাতী উপজেলার চরাঞ্চল এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে ফসলিজমি তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার মানুষ এরই মধ্যে উঁচু বাঁধে স্থান নিচ্ছে। এদিকে যমুনা নদীর শাখা পুংলী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় টাঙ্গাইল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের রানাগাছা নামকস্থানের ৫৮ মিটার অংশ বাঁধ হুমকির মধ্যে পড়েছে। বালির বস্তা ও বাঁশ দিয়ে অস্থায়ীভাবে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করে যাচ্ছেন টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। বগুড়া॥ যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যাকবলিত ৩ উপজেলা সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বাড়ছে বন্যার্তদের দুর্ভোগ। অনেক এলাকায় খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন ছুটেছেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে। এলাকাবাসী ত্রাণ সহায়তা অপ্রতুলার অভিযোগ করেছেন। পানি না কমায় দুশ্চিন্তাও বাড়ছে বাঁধের আশ্রয় নেয়া হাজার পরিবারের। এ পর্যন্ত ৩ উপজেলার ৯২ টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে ৭২ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা প্রশাসন এ পর্যন্ত ১৯০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ আড়ই লাখ টাকা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করেছে। সিরাজগঞ্জ॥ প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা পাবিত হচ্ছে। নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগও বাড়ছে। তবে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শুরু করেছে। ১৬৯ আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। গত ৭ দিনে কাজিপুর, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় ৫ শতাধিক ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি যমুনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে উঁচু বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। মুন্সীগঞ্জ॥ কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে পানি আটকে পড়ে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো। এসব পরিবারের শত শত নারী-পুরুষ ও শিশু গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে। এদিকে পানিবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে দ্রুত পানি নিষ্কাশনে মাওয়া-ভাগ্যকুল সড়কের কান্দিপাড়া এলাকায় সড়ক কেটে স্থানীয় গ্রামবাসী সরু চ্যানেল তৈরি করেছে। থাচাড় লৌহজংয়ের গাওদিয়ায় পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে ৬-৭টি বাড়ি। ভাঙ্গন রোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
×