ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ

আবারও মঞ্চে সিরাজ-উদ-দৌলা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৩ জুলাই ২০১৭

আবারও মঞ্চে সিরাজ-উদ-দৌলা

শেষ নবাব। স্বভাবতই বোঝা যায়, কে এই নবাব! হ্যাঁ। সিরাজ-উদ-দৌলা, প্রকৃত নাম মীর্জা মুহাম্মাদ সিরজ-উদ-দৌলাা। মাত্র তেইশ বছর বয়সে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মহান অধিপতি হয়েছিলেন। ইতিহাসে যার পরিচয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। প্রচ- সাহসী, দেশপ্রেমীক ও মানুষপ্রেমী এই অল্প বয়সী নবাবের সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিজের রক্ত এবং কাছের মানুষদের গভীর ষড়যন্ত্রে তাঁর পতন ঘটে। সাধারণত পরাজিত রাজা বা নবাবের ব্যর্থতা ইতিহাস খুব একটা মনে রাখে না। রাখলেও, এক রকম দায়সাড়া স্বীকৃতি তাদের কপালে জোটে। এক্ষেত্রে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের অধ্যায় একেবারেই ভিন্ন। ইতিহাস তাকে কোনভাবেই খাটো করেনি বরং, তাকে এবং তার চরিত্রকে সবসময় তুলে এনেছে ভিন্ন ভিন্ন ইতিবাচক বিশ্লেষণে। কালের পরিক্রমায় প্রজন্মের পর পজন্ম নবাবকে স্মরণ করছে, ইতিহাস জানছে নতুন করে। এই ধারাবাহিকতায় গত ৮ জুলাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চায়িত হয়েছে চারুনীড়ম থিয়েটারের ‘শেষ নবাব’ । বইতে পড়া কিংবা সিনেমায় দেখা যে নবাবকে আমি বা আমরা জেনেছি, এই নাটক তাকে এবং তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিবেচনাকে একটু আলাদা করেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। নাটক শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টায়। টিকেট দেখিয়ে হলে প্রবেশ করলাম ৭টা পাঁচ মিনিটে, নাটকের তখন সূচনালগ্ন। মঞ্চ এবং আলোকসজ্জা দেখেই ভাললাগল তারপর, আসনে বসে নাটকে করলাম মনোনিবেশ। সভায় নবাব বলছেন, ‘খোদার কসম যেদিন থেকে বাংলার নবাব হয়েছি সেদিন থেকে একটি রাতও শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি। এই উক্তিতে পরিষ্কার বোঝাই যায় যুবক নবাব দায়িত্ব গ্রহণের পর কতটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সঙ্গে দিন যাপন করতেন। এই সুযোগে, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে আরও বেশি উত্ত্যক্ত করতেন, চাপে রাখতেন যা এই সংলাপে স্পষ্ট। না, নবাবকে সেভাবে উত্তেজিত হতে দেখা যায়নি। প্রজ্ঞা দিয়ে, কখনও কখনও আবেগ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, বাংলা আমার মা তাকে রক্ষা করা আমাদের সকলের পবিত্র দায়িত্ব। যখন, ব্যর্থ হয়েছেন তখনও ক্ষোভে এবং আবেগে উচ্চারণ করেছেন ‘আমার রাজ্যে একতার দুর্ভিক্ষ, প্রত্যেকেই নিজেকে এক একজন ক্ষুদে নবাব মনে করে’ আসলে বাস্তবতা এমনি ছিল বাঙালীর মধ্যে ঐক্যের অভাব বরাবরই স্পষ্ট। তাই তো, বাঙালীদের নিয়ে এই নাটকে কট্টাক্ষের বাণী শুনিয়েছেন রবার্ট ক্লাইভের মুখ থেকে, ‘এখানে পণ্য সামগ্রীর দাম অনেক কম, আর মানুষের দাম? এত অল্প পয়সায় আর বোধহয় কোথায়ও মানুষ বিকোয় না’। অবজ্ঞার সুরে এমনও বাক্য উচ্চরণ করেছে ‘কালা আদমি আগুন জ্বালাতে জানে নেভাতে জানে না।’ ষড়যন্ত্র। নবাবের মহলে, রাজ্যের অভ্যন্তরে এবং স্বার্থসিদ্ধির অন্তরদ্বন্দ্ব সবই ছিল শেষ নবাবের নাট্যদৃশ্যে। তবে, এসবের বিরুদ্ধে নবাবকে সর্বাত্মক চেষ্ট চালিয়ে যাওয়ার যে স্পৃহা তা পরিষ্কার দেখা গেছে। অবশেষে আর না পেরে, শেষ বাক্যে গভীর কষ্টে উচ্চারণ করেছেন, ‘খোদার কসম যদি আরেক জন্মে আবার পলাশীতে আসার সুযোগ হয় তাহলে আবার আমি মীর জাফরকে বিশ্বাস করব’ এ বাক্য তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কতটা গভীর এবং একজন প্রকৃত দেশপ্রেমীকে ষড়যন্ত্রকারীদের নিকট কতটা অসহায় হতে হয় তা বুঝিয়েছেন।বেশ ভাল ছিল নাটেকের এই দৃশ্য। চরিত্র নাটকে নবাব চরিত্রে আখন্দ জাহিদের অভিনয় সত্যই প্রশংসাতুল্য। মীর জাফরের চরিত্র করা শহীদুল করিমের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি। রবার্ট ক্লাইভের চরিত্রে আল-মোতাসসীমের অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়। ঘসেটি বেগমের চরিত্রে চামেলী সিনহার অভিনয় ছিল চোখেপড়ার মতো। এছাড়া মোহনলালের চরিত্রে শাহেদ মেহেদী এবং মীর মর্দান চরিত্রের মারুফ মর্তুজারও অভিনয় ভাল ছিল। নাটকটি রচনা করেছেন প্রখ্যাত নাট্যকার সাইদ আহমেদ। নির্দেশনায় ছিলেন গাজী রাকায়েত, মঞ্চ পরিকল্পনায় ফয়েজ জহির, ব্যবস্থাপনায় ছিলেন বোরহান খান এবং আলোক পরিকল্পনায় অম্লান বিশ্বাস প্রমুখ এটি চারুনীড়ম থিয়েটারের পঞ্চম প্রযোজনা সব মিলিয়ে সাউন্ডে একটু ত্রুটি থাকা সত্ত্বে বেশ ভালই লেগেছে ‘শেষ নবাব’।
×