ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন ও তরুণ প্রজন্ম -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১৩ জুলাই ২০১৭

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন ও তরুণ প্রজন্ম -স্বদেশ রায়

২০০২ সালের ২৬ মার্চ সকাল ১০টা সাড়ে ১০টার সময় আতাউস সামাদ ভাই ফোন করে জানতে চান, আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে গিয়েছিলাম কিনা খুব সকালে। তাকে না সূচক উত্তর দিতেই তিনি বললেন, তার মানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোন প্রোগ্রাম ছিল না। তিনি সকাল ৯টা থেকে ১০টা অবধি ওই এলাকা ঘুরেছেন। কোথাও কোন প্রোগ্রামের চিহ্নমাত্র পাননি। তারপরে তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান মনে আছে কিনা? তিনি আর আমি এক সঙ্গেই ওই অনুষ্ঠান কভার করি। তাই তিনি আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে বলেন, সেদিন মানুষের কেমন গর্জন ছিল না ওই এলাকায়! যেন নতুন একটা স্বাধীনতা দিবসের আমেজ ছিল। অনুষ্ঠানটি ছিল আসলে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর। সেদিন নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ এসেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। তিনি তারপরে জানতে চান, কেন, আমি এ বছর ওই এলাকায় সকালে যাইনি। বলি, ‘ভাই, ওই এলাকায় তো কোন প্রোগ্রাম ছিল না। যেমন গত বছর প্রোগ্রাম ছিল; গত বছর খুব সকালেই গিয়েছিলাম। ’এর পর আতাউস সামাদ ভাই যা বলেন তা ছিল এমনইÑ তার মানে, বিএনপি দলটি নিজেকে এখনও স্বাধীনতার সঙ্গে একাত্ম করল না। মানুষও বিএনপিকে স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন দল মনে করে না। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর মানুষ ঘর থেকে বের হবার প্রয়োজন মনে করে না। সামাদ ভাইয়ের ওই কথার কোন উত্তর দেইনি। কারণ, তাঁর কথার উত্তর তাঁর নিজের কথার ভেতরই ছিল। অর্থাৎ বিএনপি নিজেকে যেমন স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন দল হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি, তেমনি মানুষও বিএনপি ক্ষমতায় এলে ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর ঘর থেকে বের হবার কোন তাগিদ বোধ করে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শুধু মানুষের মনে নয়, বাতাসেও যেন স্বাধীনতার একটি গন্ধ থাকে। তাছাড়া এদিনগুলোতে এতই মানুষ বাইরে আসে, যা আতাউস সামাদ ভাইয়ের ভাষায় ‘মানুষের কেমন একটা গর্জন’ থাকে সেদিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ২০২১ সালে। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেছেন, জনগণ তাঁকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করার সুযোগ দেবে। শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেছেন; কিন্তু এ দায়িত্ব কারা কাঁধে নেবে? আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নয়, সারাদেশে গর্জন তুলে কারা পালন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী? সারাদেশে স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে হবে দেশের তরুণ সম্প্রদায়কে। শাহবাগ থেকে শুরু করে সারা দেশে, প্রতি প্রান্তে আমরা জয়বাংলা ধ্বনি মুখে নিয়ে একটি তরুণ শ্রেণীকে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করা গর্জন তুলতে শুনেছি; এই গর্জন ছিল স্বাধীনতাকে ভালবাসা সেই সব সিংহ শাবকের গর্জন। এর পরে আরও পাঁচ বছর কেটে গেছে, ওই দিন যাদের বয়স তের চৌদ্দ ছিল, ২০১৯-এর আগে তাদের বয়স আঠারো হবে। অর্থাৎ আরও একটি নতুন তরুণ প্রজন্ম দেশের ভাগ্য নির্ধারণের দায় কাঁধে পাবে। তাদের এখন থেকেই এ সত্য পৌঁছে দিতে হবে। স্বাধীনতার সপক্ষে গর্জন তোলার অর্থ হলো নিজের প্রাণের গর্জন, নিজের সত্তার গর্জন তোলা। পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া নিজের অহঙ্কারকে। আর যে জাতি তার নিজের অহঙ্কারকে প্রকাশ করতে পারে না, জাতীয় অহঙ্কারে নিজেকে গর্বিত করতে পারে না, সে জাতির মতো দুর্ভাগা জাতি পৃথিবীতে আর নেই। আতাউস সামাদ ভাইয়ের কথার মূল অর্থ ধরে তাই বলা যায়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে জাতিকে সেই দুর্ভাগা জাতিতে পরিণত করে। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আতাউস সামাদ যখন বলেছিলেন জামায়াত তখনও বিএনপির সঙ্গে ছিল, তারেক নেতা হিসেবে মাথা উঁচু করতে শুরু করেছে সবে মাত্র। আর এখন তারেক তাদের মূল নেতা। যার আদর্শ নিজেই তার দলকে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ছাত্রদল আর ছাত্রশিবির একই মায়ের সন্তান।’ অন্যদিকে পেট্রোল বোমাসহ নানান পথে হাজারো মানুষ হত্যার ভেতর দিয়ে বিএনপি এখন জঙ্গীদের একটি ছাতা মাত্র। সেখানে স্বাধীনতার গন্ধ খুঁজতে যাওয়ার অর্থই হলো সাহারা মরুভূমিতে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ দেখতে যাওয়া। অন্যদিকে স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তী পালন যেমন ২০২১ সালে, তেমনি ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধু শুধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী নন, আজ এই যে আমরা বাঙালী হিসেবে পৃথিবীর বুকে আছি, আজ বাংলাদেশ সগর্বে এগিয়ে চলেছে, আজ আমাদের রবীন্দ্র, নজরুল নিয়ে আমরা গর্বিত হচ্ছি, আজ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করছে এমনকি আজ ড. ইউনূস যে নোবেল পেয়েছেন, এ সবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলে। তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি। কিন্তু তাদের জন্যে একবারের মতো সুযোগ এসেছে সাড়ম্বরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করার। আমার ধারণা ছিল, ২০১৭ থেকে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন কর্মসূচী দেবে আর তা শেষ করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে। কেন করবে? তার উত্তর ১৯৭২ সালে আহমদ ছফা দিয়ে গেছেন। তিনিই প্রথম লেখেন, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা যমজ শব্দ। আমাদের এ মুহূর্তে যারা তরুণ প্রজন্ম তারা ভাগ্যবান প্রজন্ম। কারণ, একমাত্র তাদের জীবদ্দশায় তাদের তরুণবেলায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এসেছে। আর কোনদিন এ দিনটি আসবে না এ পৃথিবীতে। যেমন, ১৯৭১ এর তরুণরা ভাগ্যবান ছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে পেরেছিলেন। আর কোনকালে কোন তরুণ এই সুযোগ পাবে না। সেদিন যারা তরুণ হয়েও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্য ছিল; মানুষ এখনও তাদের ঘৃণা করে, তাদের নাম উচ্চারণ করতেই থুথু দেয়। শুধু তাই নয়, তাদের চরিত্রও প্রমাণ করে একবার যে রাজাকার সে সারাজীবন রাজাকার। তেমনি বাংলাদেশে যে বঙ্গবন্ধু বিরোধী, সে সারাজীবন বাংলাদেশ বিরোধী। এই শ্রেণীর কোন কাজের দ্বারা কখনই বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। সম্প্রতি ইউটিউবে তারেক রহমানের একটি ভাষণ শুনেছি, সেখানে তিনি ‘প্রথমা’ (প্রথম আলো পত্রিকার একটি প্রকাশনী সংস্থা) থেকে প্রকাশিত বিভ্রান্ত এক জাসদ কর্মীর গবেষণার নামে তথাকথিত কিছু গালগল্প লিখেছেন ওই বইয়ের তথ্য উল্লেখ করেন। আর বঙ্গবন্ধু থেকে তাজউদ্দীন গুরুত্বপূর্ণ, এভাবে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার জন্য বেশ কয়েক ব্যক্তি কিছু বই লেখেন। সেসব বই থেকে খ-িত উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে তারেক রহমান কোন এক আলোচনা সভায় ওই ভাষণ দিয়েছেন। ওই ভাষণে তিনি একবারও বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু তো বলেননি, এমনকি ‘তিনি’ বলেও সম্বোধন করেননি; তিনি তাকে ‘সে’ বলে সম্বোধন করেন। আর ওই ভাষণের উপসংহারে শুধু নয়, বার বার তিনি বলছেন, ‘শেখ মুজিব রাজাকার ছিল।’ তারেক রহমানের এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, এই অপশক্তির হাতে দেশ পড়লে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এ দেশে পালন হবে কি হবে না? তরুণ প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে, বঙ্গবন্ধুর কাজের ভেতর দিয়ে একবারই বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি সারা পৃথিবীতে পরিচিত হয়েছিল। আবার বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির সামনে ২০২০-এ তেমনই আরেকটি সুযোগ আসবে। সেদিন যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশে থাকে, তরুণ প্রজন্ম যদি উদ্যোগ নেয়, তারা যদি সরকারের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কমপক্ষে একশত দেশের রাষ্ট্রনায়ক আসবেন বাংলাদেশে বাঙালীর এই চিরকালের মহামানবের জন্মশতবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি আরেক বারের মতো সারা পৃথিবীতে পরিচিত হবার সুযোগ পাবে। আগামী নির্বাচনে অনেক অর্থনৈতিক ইস্যু আসবে, ইস্যু আসবে সাফল্য ও ব্যর্থতার, ইস্যু আসবে দৈনন্দিন জীবনের নানান প্রয়োজন, দুঃখ ও ব্যথার। সে সবের উত্তর দেয়া, সেগুলো নিয়ে এগিয়ে যাওয়া রাজনীতিবিদদের কাজ। তবে আগামী নির্বাচন ঘিরে এই যে জাতীয় গৌরবের বিষয়টি সামনে এসেছে, এই গৌরবকে উর্ধে তুলে ধরার দায় তরুণ প্রজন্মের। এই সুযোগ জাতীয় জীবনে আর কোনদিন আসবে না। এ দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী একবারই আসবে আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনও একবারই আসবে। তরুণ প্রজন্মকে তাই এ দায় কাঁধে নিতে হবে, যাতে কোনক্রমেই জাতিকে এই গৌরবের রং গায়ে মাখা থেকে বঞ্চিত করতে না পারে রাজাকার, আলবদর ও তাদের আশ্রয়দাতারা। মনে রাখতে হবে, কোন জাতি তার আপন গৌরব ছাড়া বড় হতে পারে না। ইরানকে বড় হবার জন্যে, আপন গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্যে শাহনামা লিখতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনই আমাদের শাহনামা, তার নেতৃত্বে যে ২২ বছরের মুক্তি সংগ্রাম হয়, যে মুক্তিযুদ্ধ হয় সে কাব্য এখনও লেখা হয়নি। তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করার ভেতর দিয়ে শুরু করতে পারে সেই কাব্য লেখা। [email protected]
×