ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোদি কেন অর্থনৈতিক সংস্কারে যাচ্ছেন না

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ১২ জুলাই ২০১৭

মোদি কেন অর্থনৈতিক সংস্কারে যাচ্ছেন না

নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করার সময় তাকে ঘিরে এক মস্ত প্রশ্ন ছিলÑ তিনি কি প্রকৃতই অর্থনৈতিক সংস্কারক, নাকি সংস্কারকের ছদ্মাবরণে একজন হিন্দু ধর্মান্ধ? গত তিন বছরে, এ প্রশ্নের সুরাহা হয়েছে বলে মনে হয়। কখনও কখনও তিনি ধর্মীয় অনুভূতির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে একজন হিন্দু পুরোহিতকে নিয়োগ। কিন্তু এর পাশাপাশি তার নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি কতটা বেড়েছে তা একটি পরিসংখ্যানেই বুঝা যাবে। ২০১৩ সালে অর্থাৎ মোদি ক্ষমতায় আসার আগে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা ৭.৯ শতাংশে পৌঁছে। এর ফলে ভারত দ্রুততম প্রবৃদ্ধির বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়। সেসব সংস্কার কার্যক্রম বছরের পর বছর মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল সেগুলোকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি দেউলিয়া আইনকে ঢেলে সাজিয়েছেন এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নানা ধরনের লেভীর যে গোলমেলে ব্যবস্থা ছিল সে জায়গায় তিনি দেশব্যাপী বিক্রয় কর (জিএসটি) চালু করেছেন। বিদেশী বিনিয়োগ সামান্য হলেও বেড়েছে। কেবিনেট মন্ত্রীরা জোর দিয়ে বলে থাকেন মোদিন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারত অবশেষে ব্যাঘ্রে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু হায়! ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের এই চেহারা দেখলে প্রতারিত হতে হবে। জিএসটির উদ্যোগটা ভাল কিন্তু অহেতুক জটিল ও আমলাতান্ত্রিক যার ফলে এই ব্যবস্থার দক্ষতা বহুলাংশে মার খেয়েছে। নতুন দেউলিয়া আইন সঠিক পদক্ষেপ হলেও মন্দ ঋণের ভারে জর্জরিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো যে আর্থিক ব্যবস্থায় প্রাধান্য বিস্তার করে আছে সেটিকে পুনরুজ্জীবন করতে হলে আরও অনেক কিছু লাগবে। জমি কেনায় অসুবিধা থেকে শুরু করে শ্রমআইন সংস্কার পর্যন্ত বেশকিছু অর্থনৈতিক সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান অতি জরুরী। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেগুলো নিজে সমাধান না করে রাজ্যগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছে। কালো টাকার দৌরাত্ম্য বন্ধে এই সরকারের একটা বড় সংস্কার হচ্ছে বড় বড় ব্যাংক নোট রাতারাতি বাতিল। কিন্তু সেটা হিতে বিপরীত হয়েছে। এই পদক্ষেপ অবৈধ ব্যবসার তেমন একটা ক্ষতি করতে না পারলেও বৈধ ব্যবসার ক্ষতি করেছে। অবাক হবার কিছু নেই সে প্রবৃদ্ধির হার ৭.৯ শতাংশ পৌঁছার পর অর্থনীতি এখন পিছু হটতে শুরু করেছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৬.১ শতাংশ। অর্থাৎ মোদি ক্ষমতায় আসার আগে যা ছিল তার চেয়েও কমে গেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে নরেন্দ্র মোদি একজন আমূল সংস্কারক হিসেবে যে ধারণা দেয়া হয়েছিল তা তিনি নন। পূর্বসূরি মনমোহন সিংয়ের চেয়ে তিনি অধিকতর উদ্যমী। মেনুফেকচারিং থেকে টয়লেট নির্মাণ পর্যন্ত নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নিজস্ব বড় ধরনের কোন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আসতে পারেননি। ব্যবসাবান্ধব হিসেবে তার খ্যাতি শুধু এটুকুই যে তিনি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা সমাধানের জোর চেষ্টা করেন। যেমন কোন কারখানার জমি দরকার সেটার ব্যবস্থা করা কিংবা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ত্বরান্বিত করা। কিন্তু অর্থনীতি পিছু হটার অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোর সুপরিকল্পিত সমাধান দিতে তিনি মোটেই তেমন ভাল নন। উন্নয়নের জন্য ভারতের শুধু বিদ্যুত কেন্দ্র ও জমি প্রয়োজন তা নয়। দরকার এগুলোর জন্য চালু বাজার এবং মূলধন ও শ্রম। অথচ শিল্পে দেয়া ঋণের পরিমাণ ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সংকুচিত হচ্ছে, প্রবৃদ্ধিও কমে আসছে। অসংখ্য সমস্যা আছে ভারতের। মূলধন সঙ্কট আছে। শ্রমের প্রাচুর্য থাকলেও দক্ষ ও শিক্ষিত শ্রমের অভাব আছে। শিক্ষার মান শোচনীয়। তরুণ ভারতীয়দের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণ কোনটিতেই নেই। স্বাস্থ্যসেবার মানও অতি নিম্ন। এসব কিছুরই ব্যাপক সংস্কার দরকার। অথচ সংস্কারের জন্য অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ যে নেই তা নয়। মোদির সরকার কয়েক দশকের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার। নিম্ন পরিষদে এই সরকারের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে এবং উচ্চ পরিষদেও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটু একটু করে এগোচ্ছে। বেশিরভাগ বড় বড় রাজ্যের ক্ষমতায় রয়েছে মোদির দল। বিরোধী দলের অবস্থা অতি শোচনীয়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও অনুকূলে। ভারত বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে থাকে। হালে তেলের দাম কম থাকায় তা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। জনগোষ্ঠীর বার্ধক্য সমস্যা পাশ্চাত্য অর্থনীতির ওপর বেশ আগে থেকেই চেপে বসেছে এবং হালে তা চীনের উপরও ভর করেছে। সে তুলনায় ভারত এখনও তরুণ। এখন থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের শ্রমশক্তিতে যোগদানকারীদের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি হবে ভারতীয়। এসব কিছু ধরলে ভারতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর বিরাট সুযোগ আছে। শুধু তাই নয়, অন্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হারকেও ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত বছরের পর বছর ধরে। অথচ মোদি এই সুবর্ণ সুযোগগুলো হাতছাড়া করছেন। তাঁর কিছু সমর্থক অবশ্য যুক্তি দেন এই বলে যে তিনি উচ্চ পরিষদ রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সেটা হলেই তিনি বড় ধরনের সংস্কারে হাত দেবেন। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যত দিনগুলোর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে এটাও ঠিক যে অর্থনৈতিক সংস্কার যে তার অগ্রাধিকার সেটা এখনও পর্যন্ত তিনি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেননি। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×