ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

তারকা ডিফেন্ডার স্বপন দাসের দিনকাল

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১২ জুলাই ২০১৭

তারকা ডিফেন্ডার স্বপন দাসের দিনকাল

বাংলা ও ইংরেজীতে একটা পরিপূর্ণ বাক্য তৈরি করতে হলে ব্যাকরণ জানা জরুরী। খেলার ক্ষেত্রেও একজন দক্ষ খেলোয়াড় হতে হলে খেলার ব্যাকারণ জানা জরুরী। সেই ব্যাকারণ জেনেই যারা খেলাকে রপ্ত করেন তারাই একজন দক্ষ খেলোয়াড় হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। ফুটবলের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রক্ষণভাগ। যারা রক্ষণভাগের দায়িত্বে থাকেন তাদের মাথা ঠা-া রেখেই রক্ষণ দুর্গ সামলানোর কথা। কারণ বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় রক্ষণ ভাগকে ফাঁকি দিলেই সামনে একমাত্র অরক্ষিত গোল রক্ষক। কিন্তু দেখা যায় এই রক্ষণ ভাগের বেশির ভাগ খেলোয়াড়রাই বেশি উত্তেজিত অবস্থায় রক্ষণ দুর্গ সামলানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে ফলাফল অনুকূলে থাকে না। ফুটবলের এই ব্যাকরণকে যিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, যাকে খেলার মাঠে উত্তেজিত অবস্থায় কেউ কোনদিন দেখেননি। ক্লাব ফুটবল থেকে জাতীয় দলে খেলেছেন আস্থার সঙ্গে। পজিশন জ্ঞান, দু’একজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বিপক্ষ সীমানায় নিখুঁত থ্রু দিয়ে গোলের সহায়তা করতে যার জুড়ি মেলা ভার ছিল, শান্তশিষ্ট এবং ভদ্র খেলোয়াড় হিসেবেই সবার কাছে যার গ্রহণ যোগ্যতা ছিল তিনি বাংলাদেশ ফুটবলের অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলোয়াড় লেফট ব্যাক স্বপন দাস। স্বপন দাসের জন্ম মুন্সীগঞ্জে। ওয়ারী এবং ঢাকেশ্বরীতে খেলা বাবা কালীপদ দাস কে দেখে এবং তার আদর্শকে পুজি করেই বড় ফুটবলার হবার স্বপ্ন দেখতেন। যদিও স্বপন দাসের বাবা একজন দক্ষ ফুটবলার ছিলেন তথাপি স্বপন দাসকে ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে তার এক বন্ধুর অবদান বেশি বলে মনে করেন তিনি নিজেই। যার নাম জয়নাল। তিনি জানান মুন্সীগঞ্জ মহুকুমার পক্ষে খেলার জন্য মানিকগঞ্জ গিয়েছিলেন। কিন্তু খেলার দিন চূড়ান্ত লিস্টে তার নাম না দেখে তিনি হতাশ হয়ে যান। তিনি ক্ষোভে দুঃখে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। বাবার উপরেও তার একটু ক্ষোভ হয়। বাবা ইচ্ছে করলে তাকে সুপারিশ করে মূল দলে যায়গা করে দিতে পারতেন। তিনি সেটা করেননি। সেখানে উপস্থিত থাকা কাঁসা পিতলের ব্যবসায়ী জয়নাল নামের এক বন্ধু তাকে সুপারিশ ছাড়াই যে কোন দলে খেলার জন্য তৈরি হতে বলেন। স্বপন দাস সেই থেকে নিজেকে আরও কঠোর অনুশীলনে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৬-৭৭ সালে পুলিশ দল দিয়েই ঢাকা মাঠে আবির্ভূত হয়েছিলেন ফুটবলার স্বপন। লীগে ইতোমধ্যে দুই ম্যাচ শেষ। তৃতীয় ম্যাচ ঢাকা মোহামেডানের সঙ্গে। মোহামেডানে তখন গোলাম সারয়ার টিপু, মেজর হাফিজ, রামা লুসাই, ভানু দাসহ নওসেরুজ্জামান নওসেরের মতো সব নাম করা খেলোয়াড়। নওসের খেলতেন রাইট উইনিং এ। স্বপন দাস লেফট উইং এ খেলায় নওসের কে আটকানোর দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তার দল হেরেছিল ২-০ গোলের ব্যবধানে তবে সেদিন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন তার দায়িত্ব। ১৯৮২ সালের দিল্লী এশিয়াডের কথা মনে গেঁথে আছে স্বপন দাসের । প্রথম ম্যাচে ভারতের সঙ্গে ২-০ গোলে পরাজয় সবার মনে জালা ধরিয়ে দেয়। পরের ম্যাচ মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে। তৎকালীন জার্মান কোচ গের হার্ড স্মিথ দলে কিছু পরিবর্তন আনেন। লেফট ব্যাক স্বপনকে তার স্থান বদলিয়ে নাজির আহমেদ অলকের সঙ্গে লিংকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন কোচ। নিজ পজিশন বাদ দিয়ে অন্য পজিশনে খেলতে স্বপন কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন। পরে সহকারী কোচ টিপু ভাই তাকে সাহস যোগান। স্মিথ তাকে সকার বোর্ডে কলাকৌশল দেখিয়ে দেন। তার মনে আছে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে সেদিন তিনি দুর্দান্ত খেলেছিলেন যা খেলার পর কোচ স্মিথ এবং গোলাম সারয়ার টিপুর কাছে শুনেছিলেন। বর্তমানে ফুটবলের এই দৈন্যদশা থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে তিনি জানান জেলা লেভেলে ডিসিএসপি কে সঙ্গে নিয়ে ফুটবলের ক্ষেত্র তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী। স্কুল, কলেজসহ সোহরাওয়ার্দী কাপ এবং শেরেবাংলা কাপের আয়োজন করতে হবে নিয়মিত। তা না হলে যতই ভিশন করা হোক না কেন ফুটবল কখনোই জাগ্রত হবে না। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করেন যে এখনও গ্রামেগঞ্জে ফুটবলের কোন টুর্নামেন্ট হলে দর্শকদের যায়গা দেওয়া যায় না। এ থেকেই বোঝা যায় মানুষ এখনও ফুটবলকে ভালবাসে, প্রয়োজন শুধু ক্ষেত্র তৈরি করা। স্বপন দাস ছোট বেলা থেকে ফুটবল খেলে থাকলেও ১৯৭৪ সালে তৃতীয় বিভাগের দল জিঞ্জিরা ক্লাবের হয়েই তার যাত্রা শুরু। ১৯৭৬-৭৭ সালে প্রথম বিভাগ দল পুলিশে যোগ দেন স্বপন। এরপর ওয়ারী ওয়ান্ডার্স হয়ে ১৯৮০ সালে যোগ দেন তার প্রিয় ক্লাব মোহামেডানে। তিনি জানান ১৯৭৮ সালে ইয়ুথ দলের সদস্য থাকাকালীন খুবই চমৎকার খেলে সবার নজর কাড়েন। ৭৯ সালে নওসের তাকে ওয়ান্ডার্সে খেলার সুযোগ করে দেন। সে বছরেই কায়কোবাদ এবং প্রতাপ সঙ্কর হাজরা উনাকে মোহামেডানে খেলানোর জন্য তার মুন্সীগঞ্জের বাসায় যান। কিন্তু গিয়ে শুনেন স্বপন ওয়ান্ডার্সে খেলার জন্য সেদিনই ঢাকা রওনা হয়েছেন। পরের বছর আব্দুল গাফফার আর কায়কোবাদ স্বপন দাসকে নিয়ে সোনালী ব্যাংকে কর্মরত গোলাম সারোয়ার টিপুর কাছে নিয়ে যান মোহামেডানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। এবং সে বছরেই তিনি তার প্রাণপ্রিয় ক্লাব মোহামেডানে যোগ দেন এবং ১৯৮০ সালেই তিনি প্রথম চ্যাম্পিয়নের স্বাদ পান। ১৯৮৬ সালে একবার মোহামেডান ছেড়ে ব্রাদার্সে যোগ দেওয়া ছাড়া ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মোহামেডানে খেলে তিনি ৯০ সালে খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসর নেন । ক্রিকেট বর্তমান ফুটবলের প্রধান অন্তরায় এমন প্রশ্নে তিনি হাসতে হাসতে বলেন কখনই না। এখন ফুটবল ক্রিকেট দুই খেলাতেই টাকা আছে। খেলোয়াড়দের মনে রাখতে হবে বর্তমানে ভাল খেলোয়াড় হলে প্রচুর অর্থ আছে সেটা ক্রিকেট বা ফুটবল যেটাতেই হোক। স্বপন দাস জাতীয় যুব দলে খেলেন ১৯৭৮ সালে এবং তখন থেকেই জাতীয় দল ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অপরিহার্য খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন। ১৯৮৪ সালে মোহামেডানের এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের অধিনায়ক অধিনায়ক ছিলেন। ফুটবলে কোন কষ্ট আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান কষ্ট বলতে যে বাবাকে দেখে ফুটবলার হবার স্বপ্ন দেখেছিলাম ১৯৮৩ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবলে ক্রীড়া লেখক সমিতি কর্তৃক ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের খবরটা বাবা দেখে যেতে পারেননি। ক্রীড়া পরিষদে কোচিং পেশায় নিয়োজিত থেকে অবসরে যান। অবসরে যাবার পর থেকেই কোচিং পেশায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। বর্তমানে ইয়াংম্যান ফকিরেরপুলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্ত্রীসহ এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে বর্তমানে লালবাগে থাকেন। মেয়ে অর্চনা দাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এইড করছেন এবং ছেলে সৌরভ দাস ড্যাফোডিলে কম্পিউটার সাইন্সে পড়ছেন। ‘এখানে দেওয়ার আছে কিছু নেবার নাই’Ñ কোচিং পেশায় আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে গোলাম সারোয়ার টিপুর এই মহান উক্তিটিকে টনিক হিসেবে নিয়েছেন স্বপন দাস। টুর্নামেন্ট সেরা হবার পুরস্কার বাবার হাতে তুলে দিতে পারেননি ঠিকই তবে তার ইচ্ছা ফুটবলের স্বল্প মেধা দিয়ে ক্লাব ফুটবলের এবং দেশের ফুটবলের সমর্থকদের হাতে কিছু একটা তুলে দিতে পারবেন।
×