ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘সুপারস্টার মেগ ল্যানিং’

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১২ জুলাই ২০১৭

‘সুপারস্টার মেগ ল্যানিং’

অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক- দুর্দম্য, মেধাবী এবং বোলারদের ওপর প্রভাবশালী এক ব্যাটার। তার নাম মেগ ল্যানিং। তরুণীদের আর পুরুষ ক্রিকেটের দিকে মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন নেই। শিখতে হলে তার জন্য ল্যানিং আছেন। কিভাবে পদে পদে এগিয়ে যেতে হবে, নিজের আরও উন্নতি করতে হবে এবং কেমন ব্যাটিং মনোভাব হবে সেটা জানার জন্য অসি এ ক্রিকেটারকে অনুসরণ করলেই যথেষ্ট। তার প্রতিটি পদক্ষেপেই আছে দুর্বার মানসিকতার ছাপ। তার ইতিবাচক মনোভাবটা সবসময় দলের বাকিদের মধ্যে জয়ের মানসিকতা ছাড়া অন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখে না। আর এ বিষয়ে ল্যানিং নিজে রিকি পন্টিংকে অনুসরণ করতেন। তাঁকেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ‘নায়ক’ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। এ বিষয়ে ল্যানিং নিজেই বলেছেন, ‘আমার বেড়ে ওঠা রিকি পন্টিংকে নায়ক হিসেবে ভেবে। তিনি যেভাবে ব্যাট করতেন সেটা আমার দারুণ পছন্দের ছিল। যেভাবে তিনি খেলাটা খেলতেন সেটাও আমি খুব ভালবাসতাম। আমি তাঁকে সবসময় অনুসরণ করতাম!’ আর এখন সেই ল্যানিং নিজেই অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছেন। রানের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও মহিলাদের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বাধিক ১১ সেঞ্চুরি হাঁকানোর অনন্য রেকর্ড তার দখলে। ২৫ বছর বয়সী এ মহিলা ক্রিকেটার মাত্র ৬ বছরেই এই অনন্য অর্জনের মালিক হয়ে গেছেন। ক্রমেই সবার কাছ থেকে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়ার অবস্থানে চলে যাচ্ছেন ল্যানিং অপ্রতিরোধ্য গতিতে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অন্যরকম এক ভালবাসা তৈরি হয়েছিল ল্যানিংয়ের। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি স্কুলের মূল একাদশে ছেলেদের দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন। আর ১৮ বছর বয়সে সুযোগ পেয়ে যান অস্ট্রেলিয়া জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলে। ২২ বছর বয়সে হয়ে গেছেন অধিনায়ক। আর নেতৃত্ব পেয়েই দলকে মহিলা টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতিয়েছেন। সর্বকনিষ্ঠ অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটার হিসেবে সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ডও তার দখলে। মহিলা দলের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়কও তিনি। যখন ব্যাটিংয়ে নামেন সে সময় তার মধ্যে একটা তাড়া থাকে দ্রুত শেষ করার। ২০১২ থেকে শুরু করে চলমান মহিলা টি২০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত সারাবিশ্বে মাত্র ১৪ জন মহিলা ব্যাটার আছেন যাদের স্ট্রাইক রেট ৮০ ছাড়িয়ে (যারা অন্তত ৩০০ রান করেছেন)। এই তালিকায় ল্যানিং ৯৭ স্ট্রাইকরেট নিয়ে দুই নম্বর স্থানে। এই সময়সীমার মধ্যে তার ব্যাটিং গড় ৫৬’র চেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি রান করেছেন তিনিই এই ৫ বছরে। আর মাত্র ৭.৫ বলে একটি করে বাউন্ডারি আছে। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ১৯০ রানের একটি ইনিংস আছে তার এবং মহিলাদের টি২০ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসও খেলেছেন তিনিই। ১২৬ রান করেছিলেন ২০১৪ সালের টি২০ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের মেয়েদের বিরুদ্ধে। মহিলা ক্রিকেটে আরও অনেক তারকাই আছেন। বিশেষ করে মেধাবী অলরাউন্ডার এলিস পেরি এবং নাতালি স্কিভাররা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। ভারতীয় ওপেনার ও অধিনায়ক মিতালি রাজ, নিউজিল্যান্ডের সুজি বেটস, ইংল্যান্ডের স্টেফানি টেইলর ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের শার্লট এ্যাডওয়ার্ডসরা ভুবনবিখ্যাত হয়েছেন রানের ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে। কিন্তু তাদের কেউ ল্যানিংয়ের মতো ভয়ানক ব্যাটার নয়। তিনি যখন ব্যাটিং করেন প্রতিপক্ষ বোলারদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়ে যান বিধ্বংসী মনোভাবের জন্য। তার আগ্রাসী ব্যাটিং সবসময় অস্ট্রেলিয়া দলকে ফুরফুরে ও আত্মবিশ্বাসী রাখে। সাবেক ক্রিকেটার দীপ্তি শর্মা এ বিষয়ে বলেন, ‘তিনি খেলার মধ্যে যে তীব্রতার সৃষ্টি করেছেন তা খুবই পছন্দ করি। তিনি মাঠে যেভাবে প্রবেশ করেন সেটাতেই ভিন্ন মাত্রার ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। সবাই এটিকে একবাক্যে বলেন, শক্তিমান মনোভাব।’ এমন কোন মাঠ নেই যেখানে ভাল কোন ইনিংস খেলেননি ল্যানিং। আর এটাই একজন সেরা খেলোয়াড়ের লক্ষণ। যে কোন ধরনের শট খেলতেই পারঙ্গম পরিস্থিতি অনুসারে। কোন শটের মধ্যে দুর্বলতা নেই ল্যানিংয়ের। পেস এবং স্পিন উভয় ধরনের বোলিংয়ের বিরুদ্ধেই সমানে-সমান রেকর্ড তার রান করার। ক্যারিয়ারের হাফসেঞ্চুরির চেয়ে সেঞ্চুরিই করেছেন বেশি। ৬১ ওয়ানডেতে তার সেঞ্চুরি ১১টি আর হাফসেঞ্চুরি ১০টি। ল্যানিং নিজের বিষয়ে বলেন, ‘এই ফরমেটে আমার লক্ষ্য দলের হয়ে ১০০ ম্যাচ জেতা।’ কিন্তু সেটাই কেন তার উপযুক্ত উত্তর নেই ল্যানিংয়ের কাছে। শার্লট এ্যাডওয়ার্ডস ও বেলিন্ডা ক্লার্ক মিলে খেলেছেন ৩০৯ ওয়ানডে। সবমিলিয়ে দু’জনে হাঁকিয়েছেন ১৪ সেঞ্চুরি। ল্যানিং মাত্র ৬১ ম্যাচেই ১১টি শতক হাঁকান। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি একমাত্র ব্যাটার হিসেবে ১০টির বেশি সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ড গড়েছেন। ল্যানিংয়ের রেকর্ডের কারণে এখন সবারই আলোচনা তাঁকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সেটা নিয়ে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় তারা আরও ভাল কিছু পরিকল্পনা করবে আমার জন্য। সবসময় আপনাকে কিছু পরিবর্তন আনার দিকে মনোযোগী হতে হবে। বর্তমান সময়ে কোনকিছুই লুকানোর নেই। কারণ সবগুলো খেলার ফুটেজ থেকে যায়। সুতরাং সবসময়ই অনুসন্ধানীমূলক ব্যাপার ঘটে এবং এ কারণে অভিনবত্ব আনতে হবে। এ কারণে শুধু আমার জন্যই নয়, সবার জন্যই আসলে পরিকল্পনায় ভাল ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।’ ৬১ ওয়ানডেতে ৫৪.১২ গড়ে ২৯২৩ রান করেছেন ল্যানিং। ৭০ টি২০ খেলে করেছেন ৩১.৬৩ গড়ে ১৯৩০ রান। তিনি ইতোমধ্যেই বেশকিছু ব্যক্তিগত মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার জিতেছেন। তিনি ইতোমধ্যেই লাভ করেছেন বেলিন্ডা ক্লার্ক মেডেল, উইজডেন এ্যাওয়ার্ড এবং ওয়ানডে ও টি২০ ক্রিকেটে আইসিসির পুরস্কার। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই তার নামেই পুরস্কারের প্রচলন হয়ে যাবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। চলমান বিশ্বকাপে ইতোমধ্যেই ৯৪-এর ওপর স্ট্রাইকরেট ও ৮৪ এর বেশি গড়ে রান করেছেন ৪ ম্যাচে ২৫২! এ বিষয়ে ল্যানিং বলেন, ‘আমি সবকিছুকেই খুব সাধারণভাবে দেখার চেষ্টা করি। আর মূলত আমি আসলে একজন প্রতিযোগী মনোভাবের মানুষ। কিন্তু খুব বেশি চিন্তা করি না কোন একটি বিষয় নিয়ে।’ আর এভাবেই ল্যানিং এগিয়ে চলেছেন। হয়ে গেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের একজন সুপারস্টার!
×