ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদ রহমান

ফুটবলে শুধু কোচ আসে কোচ যায়

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১২ জুলাই ২০১৭

ফুটবলে শুধু কোচ আসে কোচ যায়

অনেকদিন ধরেই দেশের ফুটবল মহাসঙ্কটে পতিত। কোন আয়োজন থেকেই ভাল কোন ফলাফল বয়ে আনতে পারছে না ফুটবল দল। উল্টো মালদ্বীপ, ভুটানের মতো দেশের কাছেও এখন নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে। ফুটবলের এই মহাদুঃসময়ে বার বার বিদেশী কোচ আনা হলেও তাতে কার্যকর কিছুই হচ্ছে না। বরং ব্যর্থতার ষোলোকলাই বার বার চিত্রায়িত হচ্ছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ফুটবল দলের বিদেশী কোচ ছিলেন বেলজিয়ামের টম সেন্টফিট। কিন্তু তিনি ভুটানকে জয় করতেই ব্যর্থ হন। গত বছরের অক্টোবরে এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে ভুটানের মাঠে বাংলাদেশ ৩-১ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হলে বাফুফের সঙ্গে নতুন করে কোন চুক্তি না হওয়ায় তিনি বাংলাদেশের শুভকামনা করে বিদায় নেন। সেন্টফিট চলে যাওয়ার পর অনেকটাই কোচবিহীন থাকে বাংলাদেশ দল। আর তাই নতুন করে আবার কোচের অনুসন্ধান চলে। নতুন কোচ হয়ে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে এ্যান্ড্রু উড নামের একজন। এই কোচের বয়স তেমন বেশি নয়। আনুষ্ঠানিক চুক্তির পর তিনি কাজও শুরু করেছেন। বর্তমানে তিনি অনুর্ধ্ব-২৩ ফুটবল দল নিয়ে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত আছেন। এমাসেই ফিলিস্তিনে এএফসি অনুর্ধ্ব-২৩ টুর্নামেন্টে খেলতে হবে জর্দান, প্যালেস্টাইন এবং তাজিকিস্তানের সঙ্গে। ১৯ জুলাই বাংলাদেশকে প্রথম মুখোমুখি হতে হবে জর্দানের। এরপর প্রতিপক্ষ তাজিকিস্তান এবং প্যালেস্টাইন। নতুন কোচকে নিয়ে বাফুফে এবার আর সেই আগের মতো আগ বাড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। তবে নতুন কোচ বলেছেন তিনি ম্যাজিক্যাল কিছু করতে পারবেন না, সবকিছুই করবেন ধীরে ধীরে। সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবলে বিদেশী কোচের আগমন এবং ফলাফল খুব ভাল নয়। বরং গভীর এক তিক্ত অভিজ্ঞতাই তৈরি হয়েছে। দেশের ফুটবলের এখন যে অবস্থা তাতে মনে হয়- শুধু বিদেশী কোচ যায় কোচ আসে, ফুটবলের কিছুই হয় না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন ১৮ জন বিদেশী কোচ। এর মধ্যে প্রথম দিককার কোচেরা ভাল সফলতা দেখালেও হালে যারা আসছেন তারা কিছুই করতে পারছেন না। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম বিদেশী কোচ হয়ে আসেন জার্মানের ওয়ার্নার বেকেলহফট। এ দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখনই আনা হয় বেকেলহফকে। তাকে আনার অন্যতম কারণ ছিল বিদেশের মাটি এবং বিদেশী দলগুলোর বিরুদ্ধে যেন বাংলাদেশ ভাল করতে পারে। ওয়ার্নার বেকেলহফটের পর ৮২ সালে কোচ হয়ে আসেন জার্মানের গার্ডস্মিট। তিনিও আসেন সাং®কৃতিক চুক্তির আওতায়। গার্ড স্মিট মাত্র এক বছর কোচিং করান বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের। তার কোচিং ৮২ সালে বাংলাদেশ ফুটবল দল ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করে। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ তিনটি খেলায় অংশ নিয়ে দুটিতে পরাজিত হয় এবং একটিতে জয়লাভ করে। গার্ডস্মিথের এ ফলাফল সে সময় খানিকটা প্রশংসিতই হয় ক্রীড়ামোদীদের কাছে। ৮২ সালে গার্ডস্মিথ চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দল বিদেশী কোচবিহীন থাকে। প্রায় পাঁচ বছর পর আবার যেন সম্বিত ফিরে পান বাফুফের কর্মকর্তারা। ৮৯ সালে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ইরানের নাসের হেজাজীকে। একসময় মোহামেডান ক্রীড়া চক্রে খেলোয়াড় কাম কোচ হিসেবে যোগ দেন তিনি। তার কোচিং এবং দল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় মুগ্ধ হয়েই বাফুফে তাকে আমন্ত্রণ জানায়। বাফুফের আমন্ত্রণে সাড়া দেন নাসের হেজাজী। হেজাজীর সিলেকশনও সর্বত্র সমাদৃত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মাত্র ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় দল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। তার বহিষ্কারের কারণ ছিল ভাল ফলাফল এনে দিতে না পারা। নাসের হেজাজীর পর ৯৩ সালে কোচ হিসেবে আনা হয় সুইজারল্যান্ডের ওল্ডরিখ সোয়াবকে। কোচ সোয়াবকে আনা হয়েছিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসের ফুটবল স্বর্ণ জয়ের একান্ত বাসনায়। সোয়াব ফুটবলারদের নিয়ে প্রাণান্তকর চেষ্টাও করতে থাকেন। টুর্নামেন্টের আগে তার কোচিং পদ্ধতির অনেকেই প্রশংসাও করেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে একেবারে উল্টো ঘটনা। মালদ্বীপ, নেপালের কাছে অসহায়ের মতো অত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশের ফুটবলাররা রীতিমতো এক হ্নদয় বিদারক ঘটনার জন্ম দেয়। বিদায় করে দেওয়া হয় সোয়াবকে। এরপর বছর না ঘুরতেই অনেকটা দ্রুতই দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা হয় কোচ ম্যান ইয়াং ক্যাংকে। কিন্তু ক্যাংও বেশিদিন টিকতে ব্যর্থ হন। ৯৫ সালে বাংলাদেশে কোচ নিযুক্ত হয়ে আসেন অটো ফিস্টার। বলা যায়, বাংলাদেশে এ যাবত সর্বকালের সেরা কোচ ছিলেন তিনিই। ঘানাকে বিশ্ব যুবকাপ পাইয়ে দেওয়া এই কোচ জাতীয় দলের দায়দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমবারের মতো বিদেশী কোন টুর্নমেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য কৃতিত্বও দেখান ফিস্টার। তার কোচিং-এ ফুটবলার মুন্নার নেতৃত্বে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি ফুটবল টূর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ যেন শত বছরের কালিমা লেপন করতে সক্ষম হয়। এরপর অনেকদিন অটো ফিস্টারকে বসিয়ে রাখা হয়। ফলে অভিজ্ঞ বনেদী এই কোচ কর্মকর্তাদের ওপর ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে স্বদেশে চলে যান। পরবর্তীতে সৌদি আরব, টগো এবং ক্যামেরুন ফুটবল দলের কোচ হিসেবে তিনি কাজ করেন। অটোফিস্টার চলে যাওয়ার পর ৯৮ সালে কোচ হিসেবে যোগ দেন ঢাকার মাঠে আবাহনীর হয়ে খেলা আলোচিত ফুটবলার সামির শাকির। ইরাক জাতীয় দলে খেলা শামির সাকির ৮৭ সালে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হয়ে খেলেন। এরপর আবাহনীর কোচ হন তিনি। আবাহনীর পর মোহামেডান ক্লাবেরও কোচের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর দায়িত্ব নেন জাতীয় দলের। শুরুতে শামির সাকিরকে নিয়ে অনেক রকম প্রশ্নের অবতারণা হলেও মাঠে নিজেকে অন্যরকমভাবে মেলে ধরতে থাকেন মহা মেজাজী সামির শাকির। প্রথমে সাফ ফুটবলের আগে গোয়ায় অনুষ্ঠিত একটি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে রানার্স আপ করে ক্রীড়ামোদিদের মাঝে কিছুটা উষ্ণতা তৈরি করেন। এরপর সাফ গেমসে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করে দীর্ঘ পনেরো বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণ করেন তিনি। ফুটবলমোদিদের কাছে শামির সাকির সত্যিই একজন কৌশলী কোচ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন। কিন্তু পরবর্তীতে বাফুফে কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়া এবং শামির সাকিরের কিছু বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে অনেকটা দ্রুতই শামির সাকির পর্বের সমাপ্তি ঘটে। শামির সাকিরের পর ২০০০ সালের প্রারম্ভে অষ্টম বিদেশী কোচ হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে আসেন কোচ মার্ক হ্যারিসন। মে মাসে তার কোচিং-এ জাতীয় দল অংশগ্রহণ করে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত চারজাতি ফুটবল টুর্নামেন্টে। কিন্তু এই টুর্নামেন্ট থেকে নি®প্রাণ ফলাফল বয়ে আনেন তিনি। ফলে সহসাই তার বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। ২০০১ সালে কোচিং-এর দায়িত্ব নেন অস্ট্রিয়ান কোচ জজ কোটান। অস্ট্রিয়ান এই কোচ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশে চ্যাম্পিয়ন করার অনন্য কৃতিত্ব দেখান। কিন্তু নানাবিধ বিষয় নিয়ে বাফুফের কর্মকর্তাদের সাথে তার টানাপোড়েন ও মতবিরোধ চলতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় তল্পিতল্পাসহ তাকে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। দীর্ঘ আড়াই বছর কোচবিহীন থাকে বাংলাদেশ। এরপর আনা হয় আর্জেন্টিনা থেকে দশম বিদেশী কোচ আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানি। ক্রুসিয়ানি ফুটবলে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারলেও করাচিতে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দলকে শীর্ষে নিতে ব্যর্থ হন। এই ধারাবাহিকতায় তাকে বিদায় নিতে হয়। ক্রুসিয়ানির বিদায়ের পর কোচ নিয়ুক্ত হন ভারতের সৈয়দ নাইমুদ্দিন। কিন্তু ২০০৭ সালে তিনিও আশানারূপ অর্জনে ব্যর্থ হন। বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে তার। এরপর ২০০৮ সালে প্রথম ব্রাজিলিয়ান কোচ হয়ে আসেন এডসন সিলভা ডিডো। ডিডো শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে শাস্তির আওতায় আনলে বিষয়টি নিয়ে বাফুফের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। শেষমেশ তাকে বিদায় নিতে হয়। এরপর ক্রোয়েশিয়া থেকে আসের রবার্ট রুবচিচ। তিনিও সাফল্যের খাতা খোলার আগেই বিদায় নেন। এরপর আসেন নিকোলাই ইলিয়েভস্কি মেসোডোনিয়া থেকে। এসেই মালদ্বীপের সঙ্গে সাফের লড়াই-এ বড় পরাজয়ের স্বাদ এনে দেন। বিদায়ও তার নিশ্চিত হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশ দলের সাথে যুক্ত হন ডাচ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ, ইতালির ফাবি ও লোপেজ, স্পেনের গঞ্জালো মরেনো। আর সবশেষ ছিলেন টম সেন্টফিট। এখন নতুন যুক্ত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এন্ড্রু উড। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়-কী উপহার দেবেন তিনি? নাকি ফটো সেসনের মাঝেই সব আবদ্ধ থাকবে?
×