ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যানজট জলজটে নাকাল রাজধানীবাসী

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১২ জুলাই ২০১৭

যানজট জলজটে নাকাল রাজধানীবাসী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট যানজট ও জলজটে নাকাল রাজধানীবাসী। স্থবির হয়ে পড়ে নগরবাসীর জীবনযাত্রা। এদিন ঢাকায় রেকর্ড হয়েছে ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি। নগরীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। রাস্তাঘাট ও অলিগলি হয়ে ওঠে কর্দমাক্ত। আর পানিতে ডুবে থাকা গর্ত ও খানাখন্দে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন পথচারীরা। সারাদেশেই ভারি বর্ষণ হয়েছে মঙ্গলবার। সারাদেশে হয়েছে দেড় হাজার মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত। দেশের ওপর মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং তা আরও অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, মৌসুমি বায়ুর বর্ধিতাংশের অক্ষপাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটির বর্ধিতাংশ উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। বর্তমানে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র প্রবল অবস্থায় রয়েছে। আজ বুধবার রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। মঙ্গলবারের বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগে পড়ে সারাদেশ। রাজধানীতে সৃষ্টি হয় বন্যার আবহ। রাজধানীর আসাদগেট থেকে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত ছিল হাঁটুপানি। রাস্তার মাঝখানে একের এক সিএনজি চালিত অটোরিক্সার মেশিন পানিতে বন্ধ হয়ে যায়। স্থবির হয়ে পড়ে যান চলাচল। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। এক থেকে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে অতিষ্ঠ হয়ে পাবলিক পরিবহনের যাত্রীরা দলে দলে হাঁটতে শুরু করেন। তাদের একজন হলেন মোঃ সুজন মিয়া (৩৪)। অফিসের কাজে কাওরানবাজার যাচ্ছিলেন। শ্যামলী থেকে মানিক মিয়া এভিনিউতে পৌঁছতে দু’ঘণ্টা লেগেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। মানিক মিয়া এভিনিউতে হাঁটুপানি ডিঙিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন বেলাল হোসেন (৪১) নামে এক ব্যক্তি। পানির কারণে তাঁকে ধীরে ধীরে হাঁটতে হচ্ছিল। ততক্ষণে বৃষ্টিতে প্রায় ভিজে গেলেন তিনি। দৌড়ে টিএ্যান্ডটি মাঠের ফুটপাথের চা দোকানে আশ্রয় নিলেন। ফার্মগেট টিএ্যান্ডটি মাঠ থেকে শুক্রাবাদ নিউ মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে যেতে ৬০ টাকা চাইলেন রিক্সাচালক মোঃ ইয়াকুব। দ্বিগুণের বেশি ভাড়া চাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, গলির পুরো পথ ধরে হাঁটুপানি। পায়ে প্যাডেল মারার সুযোগ নেই। হেঁটে হেঁটে রিক্সা টেনে নিয়ে যেতে হবে। আর ভুলে গর্তে পড়ে গেলে তো রেহাই নাই বলে জানান মোঃ ইয়াকুব। মিরপুর রোডে উঠে দেখতে পেলাম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যানবাহন। পান্থপথ থেকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল পর্যন্ত হাঁটুপানি। পানির মধ্যে ধীরে ধীরে চলছে যানবাহন। সামনে খানাখন্দের ভয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পর বেলা সোয়া ১১টার দিকে শুরু হয় মুষলধারে বর্ষণ। এরপর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলিতে যানজট ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বলে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা জানান। জনকণ্ঠের প্রতিবেদকরা জানান, পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন সড়ক, কাকরাইল, মৎস্য ভবন মোড়, শান্তিনগর, মিন্টো রোড, মগবাজার, রামপুরা, শাহবাগ চত্বর, সায়েন্সল্যাব, বাংলা মোটর, ফার্মগেট, মহাখালী, মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ও উত্তরার পথে যানবাহন ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রায় থমকে থাকে। বেলা সাড়ে ৩টায় মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর যানবাহনের দীর্ঘ জট দেখা যায়। সড়কের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানির সঙ্গে নর্দমার কাদা একাকার হয়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর পথও কঠিন করে তুলেছে। পুলিশের ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম থেকে দুপুরে জানান হয়, বৃষ্টির কারণে রাজধানীজুড়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মহাখালী, বিজয় সরণি, বাংলা মোটর, ফার্মগেট, শাহবাগ, মগবাজার এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সমস্যা হচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় ভিআইপি সড়কগুলোতে সিএনজিচালিত বহু অটোরিক্সার ইঞ্জিন বিকল হয়ে আটকে থাকতে দেখা গেছে। এসব বিকল বাহন যানজট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা জানান। প্রেসক্লাব থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় করে মহাখালী আসার পথে হাইকোর্টের সামনে যানজটে পড়েন মহাখালীবাসী মাহমুদ (৩৫)। পরে টিএসসি হয়ে এগোনোর চেষ্টা করলেও ফের আটকে যান। তিনি জানান, নাজিম উদ্দিন রোডে বেশ কিছু অটোরিক্সা ও প্রাইভেট কারকে বিকল হয়ে আটকে থাকতে দেখা গেছে বলে জানান মাহমুদ। মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোড ও আশপাশের প্রতিটি সড়কে যানজট দেখা গেছে। অনেকে বিকল্প পথে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করায় গলিপথেও যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। মিন্টো রোডে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক ঘণ্টা ধরে। কেউ কেউ উল্টোপথে যাওয়ার চেষ্টা করে আরও বেশি ঝামেলায় পড়েন। বাংলা মোটরে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক বজলুর রহমান বলেন, বৃষ্টির কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফার্মগেট বিজয় সরণি, সোনারগাঁও লিংক রোড, মানিক মিয়া এভিনিউর পশ্চিম পাশে পানি জমে রয়েছে। পানির কারণেই যানজট ছাড়ানো যাচ্ছে না। রায়ের বাজার থেকে মহাখালী আসার পথে ধানম-ি ২৭ নম্বর সড়কের মাঝামাঝি থেকে মিরপুর রোডের সংযোগস্থল পর্যন্ত রাস্তায় (রাপা প্লাজার সামনে) কোমর পানি দেখেছেন নিউ ইস্কাটনের গাড়ির মেকার মোঃ সুমন (২৮)। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়কেও পানি জমে যায়। কিছুক্ষণ পর ওই সড়কের পানি নেমে গেলেও যানজট থেকে যায়। ফার্মগেট থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত সড়কটির দুই পাশে হাঁটুপানি দেখা গেছে। উত্তরা থেকে মহাখালী আসার পথে কাকলিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় যানজটে আটকে থাকতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলা মোটর মোড়ে নেমে যাওয়া বাসযাত্রী এমদাদুল হক (৪১)। রাজধানীতে দু’ঘণ্টার ভারি বর্ষণে পথচারীরা নিকটস্থ দোকান ও রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থাপনায় আশ্রয় নেন। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে যাত্রীবাহী বাহনের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁদের অনেকের হাতে ছাতা নেই। সামনে পেয়েও বৃষ্টির কারণে তাঁদের কেউ কেউ বাসে উঠতে পারেননি। রাস্তাঘাট ও অলিগলিতে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে ওইসব খানাখন্দ। এসব জায়গায় পা রাখতে গিয়ে অনেক পথচারীই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। বেলা দেড়টায় দেখা গেছে, শান্তিনগর এলাকায় থৈ থৈ পানি। কর্ণফুলী গার্ডেন থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত রাস্তায় হাঁটুপানি। ফুটপাথের দোকানপাট উঠে গেছে। অনেক দোকানে পানি প্রবেশ করেছে। পানিতে ভিজে যাচ্ছে রিক্সযাত্রীদের পা। পানি নিচে থাকা খানাখ-ের ভয়ে পথচারীর চলাচলও কমে যায়। পানির কারণে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক সিএনজি চালিত অটোরিক্সার। রাজধানীর শান্তিনগরের ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবারই বৃষ্টির সময় দোকানের ভেতরে পানি ওঠে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ফুটপাথ দিয়েও মানুষ হাঁটতে পারে না। রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের ময়লা-আবর্জনাগুলো পানিতে ভেসে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। মালিবাগ মোড় থেকে কাকরাইল, শান্তিনগর, রাজারবাগে ফুটপাথে হকারদের পণ্যের বর্জ্যগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখা হয়। বৃষ্টি হলে এগুলো ড্রেনের মুখ বন্ধ করে দেয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোন লাভ হয়নি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন আবুল হোসেন। ফকিরাপুল ও আরামবাগ এলাকাতেও একই চিত্র দেখা গেছে। নয়াপল্টন মোড় থেকে নটরডেম কলেজ পর্যন্ত পানি জমে ওঠে। ফকিরাপুলের বাসিন্দা ইউসুফ মিয়া জানান, কয়েক ঘণ্টার মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যেতে পারি না। বৃষ্টি হলে এখানে হাঁটুপানি জমে যায়। রিক্সা এ সময় যেতে চায় না। দু’একটি রিক্সা পেলেও বেশি ভাড়া চায় বলে জানান ইউসুফ মিয়া। মোঃ হান্নান জানান, বৃষ্টি হলেই রাস্তায় ৩-৪ ফুট পানি জমে যায়। তখন অনেক চেষ্টা করেও রিক্সা পাওয়া যায় না। পরে অনেক কষ্টে ভিজে ভিজে বাসে উঠতে হয়। এভাবে দিনভর ভারি বর্ষণে রাজধানীর নিম্নাঞ্চলসহ বেশিরভাগ এলাকা ডুবে গেছে। এভাবে মঙ্গলবারের বৃষ্টিতে হাজারীবাগের নিম্নাঞ্চল, রাজধানী সুপার মার্কেট, নিউ মার্কেট, ধানম-ির অনেক স্থানেই চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। পুরান ঢাকা, পীরেরবাগ, সেনপাড়া পর্বতা, শ্যাওড়াপাড়া, আদাবর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, মিরপুর, টিকাটুলি, বাসাবো, মুগদা, মধুবাজার, শ্যামলী, রামপুরা, রাজারবাগ, ফকিরাপুল, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ, মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার অজুহাত দেখিয়ে চালকরা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেন রিক্সা, অটো সিএনজি ও ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া।
×