ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানিতে জালিয়াতি ॥ আসছে খাবার অযোগ্য লবণের বড় চালান

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১২ জুলাই ২০১৭

আমদানিতে জালিয়াতি ॥ আসছে খাবার অযোগ্য লবণের বড় চালান

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সামনে পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। এ সময়ে কোরবানির পশুর চামড়া রক্ষণাবেক্ষণে লবণের চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। এছাড়া এবার আবহাওয়ার বৈরী পরিবেশের কারণে লবণ মাঠে উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। বিসিকের রিপোর্টসহ লবণ মিল মালিকদের সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার ৫ লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমে ঘাটতির বিপরীতে ৩ লাখ টন আমদানির সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তীতে তা ৫ লাখ টনে উন্নীত করা হয়েছে। শীঘ্রই এ বিষয়টি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। এদিকে, লবণ আমদানি প্রক্রিয়ায় একটি বিষয়ে বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোডিয়াম ক্লোরাইডের (খাবার লবণ) নামে আমদানি প্রক্রিয়ায় এইচএস কোড জালিয়াতির মাধ্যমে অসৎ কিছু আমদানিকারক বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেট (যা ডায়িং ফ্যাক্টরি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও ডিটারজেন্ট উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে) আমদানি করছে। ফলে এ জাতীয় ফ্যাক্টরির জন্য সোডিয়াম সালফেট আমদানি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। সোডিয়াম ক্লোরাইড ও সোডিয়াম সালফেট আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহারের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। সোডিয়াম সালফেট আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক পরিশোধ করতে হয় সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। পক্ষান্তরে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানিতে শুল্কের পরিমাণ প্রায় ৯৭ শতাংশ। এ বিষয়টি নিয়ে অপতৎপরতায় নেমেছে অসৎ আমদানিকারকরা। এসব আমদানিকারক সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে তা কখনও খোলা বা কখনও প্যাকেটজাত করে খাওয়ার উপযোগী লবণ হিসেবে ছেড়ে দিচ্ছে। এ ধরনের একটি চালান যার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন গত সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের আগেই কাস্টম শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ আটক করতে সক্ষম হয়েছে। চীন থেকে এসেছে এ চালান, যার আমদানিকারক হিসেবে নাম এসেছে খাতুনগঞ্জের মেসার্স আজমীর ট্রেডিং কর্পোরেশন ও মেসার্স আশা এন্টারপ্রাইজ। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বিষয়টি গোপন সূত্রে আগেই খবর পেয়ে বন্দরের বহির্নোঙ্গরে গত ১৯ জুন এ চালানের খালাস কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। পরবর্তীতে নমুনা সংগ্রহ করে প্রমাণিত হয় এ লবণ মানুষের খাদ্যের উপযোগী নয়। কিন্তু বিভিন্ন ডায়িং ফ্যাক্টরি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও ডিটারজেন্ট উৎপাদনসহ অন্যান্য বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। সাধারণ লবণের মতো এটি মানুষ গ্রহণ করলে তাতে জীবনঝুঁকি মারাত্মক। মিল মালিকদের বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা এ জাতীয় লবণ আমদানির সুযোগ কাজে লাগিয়ে তা কখনও ছোট কখনও বড় চালানে নিয়ে আসছে প্রায় দুই বছর ধরে। চট্টগ্রাম লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির জনকণ্ঠকে জানান, দেশে দুই ধরনের লবণ আমদানি হয়ে থাকে। একটি সোডিয়াম সালফেট ও অপরটি সোডিয়াম ক্লোরাইড। আবার বাজারজাতকরণেও দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে। এর একটি হচ্ছে ইভাপোরেট ও অপরটি মেকানাইজড। দেশে দুই শতাধিক মেকানাইজড লবণ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। আর ইভাপোরেট লবণের (সাদা ধপধপে) জন্য রয়েছে সর্বোচ্চ ৯টি কারখানা। ইভাপোরেট লবণ তৈরিতে প্রথমে লবণকে গলিয়ে পানি করে ফেলা হয়। পরবর্তীতে তা ছোট আকৃতির দানা আকারে লবণে পরিণত করা হয়। পক্ষান্তরে, মেকানাইজড লবণ তৈরি হয় মাঠ থেকে কাদাযুক্ত লবণ মিলে এনে তা মাটি বা বালিমুক্ত করে তাতে আয়োডিনযুক্ত করা হয়। সঙ্গত কারণে ইভাপোরেট লবণ ও মেকানাইজড লবণের বাজার মূল্যের ব্যবধান রয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর বিভিন্ন সঙ্কটের কারণে লবণ আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে। এবার টার্গেট দেয়া হয়েছে ৫ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর আনা হয় ৩ লাখ মেট্রিক টন। গত ১৫ জুন শিল্প মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সমন্বিত বৈঠকে বিসিকের রিপোর্ট ও লবণ মিল মালিকদের বক্তব্য সমন্বয় করে প্রথমে ৩ লাখ টন কাঁচা লবণ আনার সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তীতে তা ৫ লাখ টন করা হয়েছে। সমিতির সভাপতি নুরুল কবির জানিয়েছেন, দেশে মেকানাইজড লবণ উৎপাদনের ৮০ শতাংশ রয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে। বাকি ২০ শতাংশ রয়েছে খুলনা, ঝালকাঠি, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। লবণ মিল মালিকদের পক্ষ থেকে বরাবরই লবণ আমদানির ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নের জন্য দাবি তোলা হয়ে আসছে। কিন্তু সরকার পক্ষে রহস্যজনক কারণে তা গ্রহণ বা কার্যকর কোনটাই হয় না। গত বছর চাহিদার তুলনায় লবণের পরিমাণ কম ছিল এক লাখ মেট্রিক টন। আমদানির জন্য অনুমোদন দেয়া হয় ৩ লাখ মেট্রিক টন। এবার উৎপাদন হয়েছে ১৩ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি। কিন্তু চাহিদা রয়েছে বিসিকের তথ্য অনুযায়ী ১৬ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ঘাটতি রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন। সার্বিক বিষয় আলোচনা করে চাহিদার তুলনায় বাড়তি কিছু দিয়ে এবার ৫ লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। গেজেট আকারে এ সিদ্ধান্ত প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রচার হলেই সংশ্লিষ্ট মিল মালিকরা লবণ আমদানির সুযোগ পাবেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, খাবার অনুপযোগী সোডিয়াম সালফেট আমদানি নিয়ে। যে লবণ মানুষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিযুক্ত সে লবণই অসাধু এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী বিভিন্ন ফাঁকফোকরে এইচএস কোড জালিয়াতির মাধ্যমে কখনও ছোট বা কখনও বড় আকারের চালানে আমদানি করে আনছে। বিশেষভাবে এ জাতীয় লবণ আসছে চীন থেকে। এ জাতীয় লবণ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে ডায়িং, গার্মেন্টস, ডিটারজেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানার কাজে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানুষের জীবনের জন্য হুমকিযুক্ত এ জাতীয় লবণ (সোডিয়াম সালফেট) আমদানি হচ্ছে এবং বাজারজাতও হচ্ছে। দেখতে একই রকম হওয়ায় ভোক্তাদের পক্ষে এ জাতীয় লবণের ভিন্নতা যাচাই করা কখনও সম্ভব নয়। এমনকি খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের পক্ষেও তা যাচাই-বাছাই করা সহজ নয়। ফলে লবণ খাওয়ার ব্যাপারেও এখন ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের মানুষ। মিল মালিকদের সূত্রে আরও জানানো হয়েছে, সরকারী অনুমোদন ছাড়া খাদ্য উপযোগী লবণ আমদানি নিষিদ্ধ। কিন্তু বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহৃত লবণ আমদানি রয়েছে উন্মুক্ত। সোডিয়াম সালফেট ব্যবহৃত হয় এমন কারখানার সংখ্যা দেশে অগণিত। কিন্তু এসব কারখানার কোনটিতে কি পরিমাণ সোডিয়াম সালফেট চাহিদা রয়েছে এর কোন পরিসংখ্যান নেই। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এ জাতীয় মিল কারখানার নামে তাদের ইচ্ছেমতো সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে থাকে। এতে মিল মালিকদের কিছু সুবিধা প্রদান করা হয় বলে তাদের পক্ষে বাড়তি সোডিয়াম সালফেট আমদানিতে সুযোগ দেয়া হয় বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি মেকানাইজড লবণ উৎপাদনকারী মিল মালিকদের পক্ষ থেকে দফায় দফায় সংশ্লিষ্ট মহলগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়ে আসছে। কিন্তু সুফলতা মিলছে না। ফলে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যাপকহারে সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে তা মানুষের খাদ্যের জন্য বাজারজাতকরণের অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। এমনিতেই খাদ্যের বিভিন্ন পণ্য বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যে মিশ্রিত করার প্রবণতা বাড়ছে। এ প্রক্রিয়ায় এখন লবণও যুক্ত হয়েছে। যা শুধু দুঃখজনক নয়, বড় ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার একটি বিষয়। মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বৈঠকে মিল মালিকদের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় আনা হয়েছে। কিন্তু এ নিযে বাস্তবভিত্তিক কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। মিল মালিকদের সুপারিশ যেসব কারখানার জন্য সোডিয়াম সালফেট আমদানির সুযোগ দেয়া হয় তার পরিসংখ্যান করা হোক, নির্ণয় করা হোক তাদের চাহিদা। এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে খাদ্য অনুপযোগী লবণ আমদানি প্রবণতা হ্রাস পেতে বাধ্য। এর পাশাপাশি ইভাপোরেট লবণ ও মেকানাইজড লবণ আমদানিতে শুল্ককর আদায়ে সরকার যে লোকসান গুনছে এরও অবসান ঘটবে।
×