ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘গুরু বাবা’ ও অর্চনার কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১২ জুলাই ২০১৭

‘গুরু বাবা’ ও অর্চনার কাহিনী

শংকর কুমার দে ॥ কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারকে ‘গুরু বাবা’ বলে ডাকেন অর্চনা রানী। প্রায় দশ বছর আগে ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনীগে চাকরি করতেন তিনি। চাকরি করার সুবাদে সম্পর্ক গড়ায় পরকীয়ায়। ঢাকার মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের কাছে ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনার মামলায় সাক্ষী হিসেবে এ ধরনের জবানবন্দী দিয়েছেন অর্চনা রানী। অপহরণের দিন তার সঙ্গে অন্তত ছয়বার মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন ফরহাদ মজহার। অর্চনা রানী এ ধরনের জবানবন্দী দেয়ার পর ফরহাদ মজহার অপহরণ মামলা তদন্তে নাটকীয় মোড় নিতে শুরু করেছে। তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সূত্রে জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফরহাদ মজহারকে যশোর থেকে উদ্ধারের পর ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে তার সাক্ষাতকার দেন না তিনি। এমনকি তার সঙ্গে কথা বলতে পারেননি তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারাও। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করা হচ্ছে। ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পর আদালতে যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন তার সঙ্গে অর্চনা রানীর দেয়া জবানবন্দীর সঙ্গে গরমিল লক্ষ্য করছেন তদন্তকারীরা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অর্চনা রানী সোমবার আদালতে ১৬৪ ধারায় ও পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। তিনি জবানবন্দীতে বলেছেন, ২০০৬ অথবা ২০০৭ সালের মাঝামাঝি ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনীগে চাকরি পান তিনি। তার গ্রামের বাড়ি মঠবাড়িয়ায়। ২০০৫ সালে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে যান পিরোজপুরে মামার বাড়িতে। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৭ সালের মাঝামাঝিতে ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনীগে চাকরি নেয়ার পর ১৫ দিনের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় তাকে। টাঙ্গাইলে উবিনীগের কার্যালয়ে ট্রেনিং হয় তার। ট্রেনিংয়ের পর তার কর্মস্থল হয় কক্সবাজারে উবিনীগে। তার (অর্চনা) সঙ্গে তার পরিচয় ফরহাদ মজহারের কক্সবাজারেই। পরিচয় হওয়ার পর তিনি ফরহাদ মজহারের ভক্ত হয়ে যান। তাকে ডাকা শুরু করেন ‘গুরু বাবা’। গুরু বাবার সঙ্গে তার দৈহিক সম্পর্কে গড়ায়। অর্চনা রানী তার জবানবন্দিতে বলেছেন, কক্সবাজার থেকে তিনি বদলি হন ঈশ্বরদীতে। ঈশ্বরদীতে থাকাকালেই গুরু বাবার সঙ্গে তার প্রথম দৈহিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারপর এ সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিন। টাঙ্গাইলে বদলির চাকরির সময়ে সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন ফরহাদ মজহার। একপর্যায়ে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি জেনে যান তার স্ত্রী ফরিদা আকতারও। এরপর চাকরি থেকে বের করে দেন অর্চনাকে। চাকরি থেকে বের করে দিলেও ফরহাদ মজহারের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল তার। প্রায়ই ফোনে কথা হতো দু’জনের। অর্চনা রানী জবানবন্দীতে বলেন, বর্তমানে তার বাসা ঢাকার নুরের চালায়। সেখানেও প্রায়ই আসতেন ফরহাদ মজহার। প্রায় দুই বছর আগে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন অর্চনা। এরপর ফরহাদ মজহারের নির্দেশে মালিবাগের একটি ক্লিনিকে গর্ভপাত ঘটানো হয় তার। অর্চনাকে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ দিতেন ফরহাদ মজহার। বর্তমানে ভাটারা এলাকায় টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-তরকারি সরবরাহ করে জীবননির্বাহ করছেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন অর্চনা রানী। জবানবন্দিতে অর্চনা আরও বলেন, চলতি বছরের এপ্রিলে আবারও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তিনি। তার কাছে টাকা না থাকায় চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি। ফরহাদ মজহারের কাছে টাকা চান। গত ৩ জুলাই সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ফরহাদ মজহার ফোনে তাকে জানান, তোমার টাকার জন্য বের হয়েছি। এরপর তিনি (অর্চনা) বেলা ১১টার দিকে ফরহাদ মজহারকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, তিনি (ফরহাদ মজহার) অপহরণ হয়েছেন কিনা? ফরহাদ মজহার বলেন, ভাল আছেন তিনি। এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফোন করে টাকা পাঠানোর জন্য একটি এ্যাকাউন্ট নম্বর চান। এরপর অর্চনার কাছে দুইটি এ্যাকাউন্টস নম্বরে ১৫ হাজার টাকা পাঠান তিনি। গত ৯ জুলাই ডিবি রাঙ্গুনিয়া থানা-পুলিশের সহায়তায় অর্চনাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন বলে অর্চনা তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ফরহাদ মজহার পুলিশের কাছে ১৬১ ধারা ও আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেছেন, গত সোমবার ভোরে রাজধানীর শ্যামলীর রিং রোডের বাসা থেকে চোখের ওষুধ কিনতে বের হন তিনি। এরপর শ্যামলীর কাছ থেকে তিনজন অপরিচিত লোক জোর করে তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় তাকে। তার চোখ বেঁধে গাড়ির সিটে বসানো হয়। তিনি নিজেই অপহরণকারীদের টাকা দিয়ে মুক্তি পেতে চান। এর কিছুক্ষণ পরই তিনি স্ত্রী ফরিদা আকতারের মোবাইলে ফোন দিয়ে নিজের অপহরণ হওয়ার কথা জানান তিনি। তাকে মেরে ফেলা হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন। পরে তিনি কয়েক দফায় ফোন দিয়ে মুক্তি পেতে ৩৫ লাখ টাকা দেয়ার কথা বলেন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনায় করা মামলার তদন্তে নাটকীয় মোড় নিতে শুরু করেছে। তদন্তে উঠে আসছে নতুন তথ্য। ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনার দিন দুইটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছেন। একটি মোবাইল ফোনে তার স্ত্রী ফরিদা আকতারের সঙ্গেও ছয়বার কথা হয়েছে তার। গ্রামীণফোনের একটি নম্বর অপহরণের ঘটনার পর ফরহাদ মজহার মোট ৬ বার কথা বলেছেন অর্চনার সঙ্গে। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ফরহাদ মজহার ১৬৪ ধারায় আদালতে ও ১৬১ ধারায় পুলিশের কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন। তার দেয়া জবানবন্দীতে গরমিল পাওয়া যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার সুস্থ হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান, এ কর্মকর্তা।
×