ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তামণির হাতটি যেন একটি গাছের গুঁড়ি, ঢেকে আছে বাকলে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১২ জুলাই ২০১৭

মুক্তামণির হাতটি যেন একটি গাছের গুঁড়ি, ঢেকে আছে বাকলে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ জন্মের দেড় বছর পরই মুক্তামণির ডান হাতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে থাকা তার হাতটি ধীরে ধীরে একটি গাছের গুঁড়ির মতো হয়ে উঠছে যার চার পাশের আকার গাছের বাকলের মতো। ১২ বছরের শিশু মুক্তামণি এভাবেই কাটিয়েছে ১১টি বছর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের সেই গুঁড়িটি এখন বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে রোগটি হাত থেকে বুকের আশপাশেও ছড়িয়েছে। আক্রান্ত স্থান থেকে ছুটছে বিকট গন্ধ। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়েও তার কোন উন্নত চিকিৎসা হয়নি। বিরল রোগে আক্রান্ত সাতক্ষীরার শিশু মুক্তামণিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে, তার চিকিৎসায় আট সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে মুক্তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে ঢামেক বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসক ডাঃ সামন্ত লাল সেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি এবং বার্ন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রাথমিকভাবে তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। বর্তমানে মুক্তার শারীরিক অবস্থা অস্ত্রোপচার করার অবস্থায় নেই। এছাড়া, তার রক্তশূন্য দেহে রক্ত দেয়া হচ্ছে। উন্নত মানের খাবার খাইয়ে তাকে সুস্থ করে তোলবার পর মূল চিকিৎসা শুরু হবে তাই দু’সপ্তাহ তত্ত্বাবধানে রেখে বিভিন্ন পরীক্ষা শেষে মূল চিকিৎসা শুরু করা হবে। এছাড়া সরকার থেকে মুক্তার চিকিৎসার সব ধরনের দায়িত্ব নেয়ার কথাও জানান তিনি। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় মুক্তামণি তার বিরল রোগের সঠিক চিকিৎসা পেতে ঢামেকে ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে সে ঢামেকের বার্ন ইউনিটের ৬০৮ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন। তার সঙ্গে রয়েছেন বাবা ইব্রাহীম হোসেন ও মা আসমা খাতুন। মেয়ের হাতে বেড়ে ওঠা বিরল রোগের জন্য বহুবারই বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে এই মা-বাবাকে। এবার মেয়ের উন্নত চিকিৎসা হবে ভেবে দুঃখের মাঝেও তাদের মনে উঁকি দিচ্ছে প্রশান্তি । মুক্তামণির বাবা জনকণ্ঠকে জানান, মুক্তামণি ও হীরামণি দুজন যমজ। তার দুই যমজ কন্যার মধ্যে হীরামণি বড় ও মুক্তামণি ছোট। জন্মের প্রথম দেড় বছর ধরে ভালই ছিল হীরামণি ও মুক্তামণি। কিছু দিন পর মুক্তামণির ডান হাতে একটি মার্বেলের মতো গোটা দেখা দেয়। এরপর থেকে তা বাড়তে থাকে। সঙ্গে চলে স্থানীয় চিকিৎসাও। দেখলে মনে হবে গাছের বাকলের (ছালের) মতো ছেয়ে গেছে পুরো হাতটি। আক্রান্ত ডান হাত তার দেহের সব অঙ্গের চেয়েও ভারি হয়ে উঠেছে। বিকট যন্ত্রণায় মুক্তামণি সব সময় অস্থির। ডাক্তার বলছেন, এ ব্যাধি তার দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।’ ইব্রাহীম হোসেন আরও জানান, বর্তমানে মুক্তার সারাদেহে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তার শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে। শুধু হাতের ভার বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দেখানো হয়েছে মুক্তামণিকে। কেউ কোন সঠিক চিকিৎসা দিতে পারেননি। রোগের মাত্রা শুধু বেড়েই চলেছে। হতাশ বাবা ইব্রাহীম গত ছয় মাস যাবত চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় মুক্তাকে বাড়িতে রেখে কেবল ড্রেসিং করছেন। সাতক্ষীরার কামারবাইশা প্রাইমারী স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী মুক্তামণি। তিন বছর আগেও সে স্বাভাবিকভাবেই নিয়মিত স্কুলে যেত। শারীরিক জটিলতায় সে এখন আর স্কুলে যেতে পারে না। সহপাঠীরাও তাকে দেখলে ভয় পায়। এছাড়া গ্রামের প্রতিবেশীরাও মুক্তার পরিবারের আশপাশেও অবস্থান করতে ভয় পায়। এজন্য এতো দিন লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল বিরল রোগে আক্রান্ত মুক্তা। স¤প্রতি মুক্তামণির এই বিরল রোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মুক্তার চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নেন। আর পাঁচ দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতই বাঁচতে চায় মুক্তামণি। সে সুস্থ হয়ে আবার স্কুলে যেতে চায়। যে মা দশ মাস দশ দিন মুক্তামণিকে গর্ভে ধারণ করেছেন-ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা দেখছেন তিনিও চান তার কন্যা সুস্থ হয়ে উঠুক। অনেকটা সময় তাকে ঘরের ভেতরেই রাখতে হতো লোকচক্ষুর আড়ালে। সেই মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে- চিকিৎসকদের কাছ থেকে এমন আশার কথা শুনে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত মুক্তামণির মা আসমা খাতুন।
×