ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ॥ বন্যার্তদের মাঝে খাদ্য সঙ্কট

উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১২ জুলাই ২০১৭

উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশে অব্যাহত বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যার কারণে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় প্রায় সাড়ে ৬ লাখ লোক পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থান এবং বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়া মানুষগুলো নিজেদের পাশাপাশি গবাদিপশু নিয়েও বিপদে পড়েছে। মানুষ এবং গবাদি পশু নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করতে হচ্ছে। বন্যার্ত মানুষের মাঝে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ত্রাণ তৎপরতাও অপ্রতুল। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, প্রধান প্রধান নদীগুলোর সমতলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধলেশ্বরী, সুরমা কুশিয়ারাসহ প্রধান নদীগুলোর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে সারাদেশের ওপর মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে সারাদেশে ভারিবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। এর প্রভাবে আরও কয়েকদিন ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। জনকণ্ঠের সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় লাখ লোক পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রাম জেলা। এ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও চরাঞ্চলে ৩ লাখ লোক পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া নীলফারামীতে ২০ হাজার, জামালপুরে ৭৪ হাজার সিরাজগঞ্জে ১ লাখ, গাইবান্ধায় ৭৫ হাজার এবং বগুড়ায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এদিকে উজান থেকে নেমে আসা পানির পাশাপাশি দেশের ভেতরে আগামী কয়েকদিন ভারিবর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আবহাওয়া অফিসে আবহাওয়া বিদ আব্দুর রহমান জানান, দেশের মৌসুমি বায়ু অধিক সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে মঙ্গলবার প্রায় সারাদিনই রাজধানীসহ সারাদেশে ভারিবৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া সতর্ককরণ বার্তায় বলা হয়েছে আজ বুধবারও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারিবর্ষণ হতে পারে। ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ী এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভারি বর্ষণের কারণে দেশে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ হয়ে উত্তর পূর্বদিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্তও বিস্তৃত। বর্তমানে মৌসুমি বায়ু বঙ্গোপসাগরের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। এ কারণেই দেশের ভেতরে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এদিকে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামসহ বেশ কয়েক জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে সমতলে ১৩টি স্টেশনে প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে বাহাদুরাবাদ ঘাটে যমুনা নদী ৬৪ সেন্টিমিটার বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও সারিয়াকান্দিতে ৪০ সেন্টিমিটার, বাজিপুরে ৪২ সেন্টিমিটার, ও সিরাজগঞ্জে যমুনা নদী ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রামে ধরলা নদী ১৫ সেন্টিমিটার, ডালিয়ায় তিস্তা নদী ১৪ সেন্টিমিটার, গাইবান্ধায় ঘাঘট নদী ২৭ সেন্টিমিটার, চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র ২৩ সেন্টিমিটার, এলাসিনে ধলেশ্বরী ২৫ সেন্টিমিটার, কানাইঘাটে সুরমা নদী ৫৯ সেন্টিমিটার, অমলশীদে কুশিয়ারা ৬৩ সেন্টিমিটার, শেওলায় কুশিয়ারা ৬২ সেন্টিমিটার, জারিয়াজঞ্জাইলে কংশ নদী ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানি কারণে নদ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, সরদার উদয় রায়হান জানান, ব্রহ্মপুত্র যমুনা, গঙ্গা পদ্ম নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি সমতলে হ্রাস পাচ্ছে। তবে সুরমা নদীর পানি সমতলে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তিনি জানান আগামী ৪৮ ঘণ্টা নাগাদ এসব নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। কুড়িগ্রাম ॥ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ৮টি উপজেলায় প্রায় তিন শতাধিক গ্রাম এখন পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীব্র স্রোতে চিলমারীর কালুয়ার চরের বাঁধে বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। বন্যাকবলিত উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর ও সদর উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নে ৪০৫টি চর-দ্বীপচরে ২ শতাধিক ৭৫টি গ্রামের তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যা কবলিত বেশিরভাগ এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। এসব এলাকায় বানভাসী মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে ৩২টি কমিউনিটি ক্লিনিকের চারপাশে পানি ওঠায় যোগাযোগ সঙ্কটের কারণে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। জেলা ত্রাণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, বন্যার্তদের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক বন্যাকবলিত মানুষের জন্য তা অপ্রতুল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে বন্যার পানিতে জেলায় ৭শ’ ৭১ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে উঠতি আউশ ৭৪ হেক্টর, বীজতলা ১শ’ ১৩ হেক্টর, সবজি ৩শ’ ৪৪ হেক্টর, পাট ২শ’ হেক্টর এবং আখ ৪২ হেক্টর। সিরাজগঞ্জ ॥ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ৫ উপজেলার চরাঞ্চলের ২৮টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে । যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই জেলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলসহ সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার বেশ কিছু নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে, পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুরের আরকান্দি থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরী পর্যন্ত নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ডুবে গেছে এসব অঞ্চলের ফসলি জমি। পানি বাড়ার কারণে আমন ধান ও পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নদী তীরবর্তী এলাকায় ফসলি জমি পানিতে ডুবে গেছে। বন্যাকবলিত মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। গাইবান্ধা ॥ গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সোমবার আরও অবনতি হয়েছে। বন্যায় ফুলছড়ি উপজেলার ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ চরাঞ্চল বেষ্টিত ৫১টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে বন্যার পানি ওঠায় পাঠদান বিঘিœত হচ্ছে। অপরদিকে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ৪ উপজেলার প্রায় ৭৫ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দী। নিম্ন ও চরাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, ফসলি জমি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। বগুড়া ॥ বগুড়ার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ভারিবর্ষণের সঙ্গে উজান থেকে আসা ঢলে যুমনা নদীতে পানি আরও বেড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যার্তদের দুর্ভোগ বাড়ছে। পাশাপাশি নতুন করে শঙ্কায় পড়েছে। এপর্যন্ত ৩ উপজেলার ৭৫টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার যমুনা তীরবর্তী ১৪টি ইউনিয়নের ১৩ হাজারেরও বেশি পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবার। বন্যার্ত লোকজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বাঁধে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলোকে তাদের গবাদি পশু নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করতে দেখা গেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার পানির সঙ্কট। ৩টি উপজেলার ৮২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করার কারণে তা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দি উপজেলাতেই প্রাথমিক মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ৬৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যাকবলিত উপজেলা ৩টির পাট, ধান, সবজি ও বীজতলাসহ ৩ হাজার ৩শ’ ৪০ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে ক্ষতি হয়েছে। জামালপুর ॥ জামালপুরের জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। জেলার দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। দুই উপজেলায় কমপক্ষে ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ইসলামপুর উপজেলার সঙ্গে ওই ইউনিয়নগুলোর যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ডুবে সোমবার রাতে জেলার ইসলামপুর উপজেলার বেলগাছা আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার দরিদ্র বজলুুর রহমানের শিশুপুত্র রিপন (১০) মারা গেছে। দুর্গতদের আশ্রয়ের কোন ব্যবস্থা না করায় হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণের চাল ও শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হলেও চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। নীলফামারী ॥ উজানের ঢল আর ভারিবর্ষণের কারণে তিস্তা নদী বেষ্টিত এ জেলার দশ ইউনিয়ন এবং ২০টি চর গ্রামে দেখা দিয়েছে বন্যা।
×