ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

এক শতাংশের হাতেই যাচ্ছে সব

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১২ জুলাই ২০১৭

এক শতাংশের হাতেই যাচ্ছে সব

ভারতের জাতীয় ম্যাগাজিন ফ্রন্টলাইন বছর কয়েক আগে তাদের এক সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল ‘সরকার : ধনীর, ধনীর জন্য, ধনীর দ্বারা’ শিরোনামে। গরিবের স্বার্থ থেকে দূরে সরতে সরতে রাষ্ট্র হয়েছে দুর্নীতি ও মুনাফার এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ; যেখানে বাস করে কেবল ধনী, ধনী এবং ধনীরা। ফ্রন্টলাইন শুধু ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের বৈষম্যের ব্যবচ্ছেদ করেছিল। সে রকমই ইকোনমিস্ট তুলে ধরেছিল গোটা পৃথিবীর চিত্র। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দশ শতাংশ মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে মোট আয়ের বিয়াল্লিশ শতাংশ। আর বিশ্ব জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতম দশ শতাংশের আয় শতকরা এক ভাগ। বৈষম্যের এ ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। আমেরিকায় সবচেয়ে ধনী এক শতাংশের হাতে রয়েছে মোট জাতীয় আয়ের শতকরা বিশ ভাগ। গত শতকের আশির দশকে যা ছিল দশ ভাগ। আর আয় বণ্টনের তালিকায় শীর্ষ দশমিক শূন্য এক ভাগ আমেরিকানের মোট জাতীয় আয়ের হার এই তিরিশ বছরে চার গুণ বেড়েছে। এর অর্থ হলো তিরিশ বছর আগে যা ছিল জাতীয় আয়ের শতকরা এক ভাগের কিছু ওপরে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা পাঁচ ভাগে। এরা হচ্ছে আমেরিকার প্রায় ষোলো হাজার পরিবার, যাদের গড় আয় দু’কোটি চল্লিশ লাখ ডলার। আয় বণ্টনের এই চরম অসাম্য বা অসঙ্গতি শুধু আমেরিকায় নয়, ব্রিটেন, কানাডা, ভারত, চীন, সুইডেনসহ বহু দেশেই রয়েছে। এসব দেশেও এক শতাংশের হাতে চলে যাওয়া জাতীয় আয়ের ভাগ ক্রমশ বাড়ছে। অতিরিক্ত ধনীর সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই বেড়েছে। বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা এখন বারো শ’ দশ। এর মধ্যে আমেরিকায় চার শ’ একুশজন, রাশিয়ায় ছিয়ানব্বই, চীনে পঁচানব্বই এবং ভারতে আটচল্লিশজন। আমেরিকার আরেক ম্যাগাজিন ফরবিসের জরিপে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই বিলিয়নিয়ারদের সম্মিলিত সম্পদ সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ডলার। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনই বলেছে আইএমএফের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আয়বৈষম্য প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর করে, আর্থিক সঙ্কট ডেকে আনে এবং চাহিদা কমায়। আরেক রিপোর্টে এডিবি বলেছে, গত বিশ বছরে এশিয়ার উদীয়মান দেশে সম্পদের অপেক্ষাকৃত বেশি সুষম বণ্টন হলে প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুত বাড়ত এবং এ অঞ্চলের আরও চব্বিশ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারত। এসব সমীক্ষা বা গবেষণা নিয়ে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু আয়বৈষম্য যে আগামী দিনগুলোতে অনেক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রায় সবাই একমত। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক সমীক্ষা আয়বৈষম্যকে আগামী দশকের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেছে। ক্রমশ বেড়ে চলা বৈষম্য ও এর ভবিষ্যত গতিমুখ খুবই বিপজ্জনক। ইকোনমিস্টের মন্তব্য অসাম্য সমাজে বড় ধরনের বিরূপ পরিণতি ডেকে আনে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, কাদের জন্য বিরূপ পরিণতি? সে কি ওই বিলিয়নিয়ার বা অতিমাত্রায় সম্পদ কুক্ষিগত করেছে যারা তাদের জন্য? অর্থাৎ মোটা দাগে এমন সিদ্ধান্তে আসা যে, বঞ্চিতরা একযোগে ফুঁসে উঠে আরেকটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে। বিষয়টা কি এতই সরল? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র নতুন করে আলোচনায় এসেছে। অন্তর্গত অনেক বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। যে পদ্ধতিতে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজকের দিনে তা হয়ত প্রাসঙ্গিক নয়। একদিকে পুঁজিবাদ নিজেরই বৃত্তে আটকাচ্ছে, অন্যদিকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। মানব সমাজের ভবিষ্যত পথপরিক্রমা তাহলে কোন্ দিকে? মানবিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত এরিক ফ্রম বলছেন, ‘অনুন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক বিকাশ আগামী শতবর্ষের চরিত্র নির্ধারণ করবে। তাদের সামনে বিকল্প পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র নয় বরং সর্বাত্মবাদী সমাজতন্ত্র অথবা মার্কসীয় মানবিক সমাজতন্ত্র। সাবেক উপনিবেশ জাতিগুলোর এই বিকাশের নেতৃত্বকে পশ্চিমের অনেক দেয়ার আছে। আর তা শুধু পুঁজি ও টেকনিক্যাল পরামর্শ নয়, পশ্চিমা মানবিক ঐতিহ্য সম্ভাবনা বিকাশে শুধু বাইরের জিনিস থেকে নয়, কোন কিছু করতে স্বাধীন হওয়ার মানবমুক্তির পশ্চিমা ঐতিহ্য, মানব মর্যাদা ও ভ্রাতৃত্বের ঐতিহ্যও সেই সহায়তার অংশ। সমাজতন্ত্রকে কলকব্জা জোড়া লাগানো সুইচ টেপা যন্ত্রের মতো দেখার মধ্যে বিপদ আছে। সমাজতন্ত্রকে যদি ‘ইতিহাসের পরিকল্পনা’র অনিবার্য ফল হিসেবে দেখা হয়, তাহলে তার সঙ্গে নিয়তিবাদের কোন তফাত থাকে না। আবার নির্ধারিত সঠিক পার্টি লাইন হলেই চলমান সমাজে সঠিক কাজ বেরিয়ে আসবে, এ কথাও সেই নিয়তিবাদের ফল। মার্কস নিজেই তার ভাবনায় প্রতিনিয়ত ঘটমান নতুন বাস্তবতার জন্য জায়গা রেখেছেন। ফলে তিনি এমন কোন তত্ত্ব দিতে চাননি, যেখানে ‘সংখ্যা বসিয়ে বোতাম চাপলেই ক্যালকুলেটরের মতো সমাধান বেরিয়ে আসবে।’ কাজেই পৃথিবীজোড়া এই আয়বৈষম্য সমাজে যে সঙ্কট ঘনীভূত করছে তার বহির্প্রকাশ বা রূপান্তর বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তিতেই হবে। তবে বিকাশের এই স্তরে এসে সমাজ যেন ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে। শ্রমিক শ্রেণীর চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যও আগের মতো থাকছে না। মজুরি বৈষম্য বাড়ছে, বাজার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিতেও বিপ্লব এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তি অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধনী দেশগুলোতে মজুরি বৈষম্যের অন্যতম কারণ দক্ষতাভিত্তিক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন পরস্পর পরিপূরক হয়ে এগুনোর ফলে গত এক-দেড় দশকে বিশ্ব পরিস্থিতি টালমাটাল। কোন পথই যেন পরিষ্কার চোখে পড়ছে না। সম্পদের পাহাড় যাদের হাতের মুঠোয় রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রও তাদের নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ যখন সামন্ত প্রভুদের হাতে ছিল তখন আইন-কানুন, রীতি, শিক্ষা, সংস্কৃৃতি সামন্ত সমাজের উপযোগী হয়েই বিকশিত হয়েছে ও তা সামন্ত প্রথাকে সমর্থন করেছে এবং তা টিকিয়ে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। সময়ে সামন্ত ব্যবস্থাকে হার মানিয়ে বুর্জোয়া ব্যবস্থা রাষ্ট্রের দখল নিয়েছে। এরপর বিশ্বের বড় দুটো ভূখ-ে বুর্জোয়া ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র এসেছে। শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে দেশে সে দেশে তার পতনও হয়েছে। ‘শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র’ও আজকের বাস্তবতায় প্রশ্নহীন নয়। চীনের সমাজতন্ত্র সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে বিরোধী শিবিরের সঙ্গে বলা যায় দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নব্বই দশকের পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ঝড়ের তা-ব লেগেছে সেখানে নিজের মতাদর্শের পক্ষে চীন খুব কমই ভূমিকা রাখতে পেরেছে। সমাজ গতিশীল, তাই বিভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় তা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। এখন যে সময় যাচ্ছে এরও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিণতি নিশ্চয়ই আছে। এক সময় এ অবস্থায় পরিবর্তন আসবে। কিন্তু কোন্ পদ্ধতিতে তা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় না। এটুকু বলা যায়, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিবর্তনের চেষ্টা ও তার বাস্তব ভিত্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলেও এর তাত্ত্বিক বা দার্শনিক বিশ্লেষণ কিন্তু হারিয়ে যায়নি। তবে পরিবর্তন আসতে হবে গোটা পৃথিবীতে। এখন যেমন বিশ্ব ভাসছে বাজারের স্র্রোতে, পরিবর্তিত পৃথিবীকেও এ রকম এক একক সত্যের আওতায় আসতে হবে। তা হলেই হয়ত পরিবর্তন সুসম্পন্ন হতে পারবে। সমাজে অন্যায়, অসাম্য যত বাড়বে পরিবর্তনের সম্ভাবনাও তত বেশি ইতিবাচক হবে। বৈষম্যের বিশাল গহ্বরে দাঁড়িয়ে এই প্রতীক্ষাই আগামী দিনগুলোকে অর্থময় করে তুলবে।
×