ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জুনোটিক ভাইরাস ॥ প্রাণী থেকে মানবদেহে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১১ জুলাই ২০১৭

জুনোটিক ভাইরাস ॥ প্রাণী থেকে মানবদেহে

মানবদেহে যে নতুন নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো অন্য প্রাণীর দেহ থেকে আসে। এবোলার কথা বলুন, সার্সের কথা বলুন আর এইডসের কথা বলুন সবই এভাবেই শুরু হয়েছে। জীবজন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীও উৎস। তাই পাখি ও জীবজন্তুর ওপর নজর রাখা, কোন্ কোন্ ভাইরাস তারা বহন করে এবং কোন ভাইরাসগুলো মানবদেহে পাওয়া যায় সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা বিচক্ষণতার পরিচয়। আর এই দায়িত্বটা স্বপ্রণোদিতভাবেই কাঁধে নিয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইকোহেলথ্ এলায়েন্স। সম্প্র্রতি এই সংস্থার সর্বশেষ গবেষণার ফলাফল ‘নেচার’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ‘জুনোটিক’ ভাইরাস সম্পর্কে লোকে জানে কি জানে না এবং এ ব্যাপারে তারা কি করে সেটা মূল্যায়ন করে দেখা হয়েছে। ড. কেভিন অলিভালের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণাটি অবশ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। কাজেই এভিয়ান ফ্লু’র উৎসের মতো বিষয়গুলো এই গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তবে বিষয়বস্তুর পরিধির মধ্যে গবেষণাটি যতটা সম্ভব সর্বাঙ্গীণ হয়েছে। গবেষণায় অন্তত পক্ষে একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহে দেখতে পাওয়া গেছে এমনি ৫৮৬টি ভাইরাসের সবই খতিয়ে দেখা হয়েছে। এই স্তন্যপায়ীরা ৭৫৪ প্রজাতির যার মধ্যে মানুষও আছে। এরা ১৫টি গোত্রে বিভক্ত যেমন প্রাইমেট বাদুর, মাংসাশী প্রাণী, খুরওলা প্রাণী ইত্যাদি। খুরওলা প্রাণীদের মধ্যে আছে হরিণ, গরু, মহিষ, মেষ এন্টিলোপ, উট ইত্যাদি। যেসব ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে ২৬৩টি অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ মানবদেহে পাওয়া গেছে। ১৮৮টি ভাইরাস জুনোটিক এবং সেটা এই অর্থে যে এগুলো অন্য স্তন্যপায়ী প্রজাতিগুলোর মধ্যে ও অন্তত একবার পাওয়া গেছে। এ থেকে অবশ্য প্রমাণ হয় না যে ভাইরাস জীবজন্তু থেকে মানবদেহে ছড়ায়। ভাইরাস অন্য পথ দিয়েও গমনাগমন করতে পারে। তবে এটাই হলো গবেষণার যাত্রাবিন্দু। ড. অলিভাল ও তার গবেষক দলের লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটা মডেল গড়ে তোলা যার দ্বারা একটি নির্দিষ্ট প্রাণী প্রজাতি কতগুলো জুনোটিক ভাইরাস বহন করতে পারে। তার পূর্বাভাষ দেয়া এবং তারপর সেই প্রজাতিটি ইতোমধ্যে কতগুলো ভাইরাস বহন করেছে বলে জানা আছে সেটার সঙ্গে তুলনা করে দেখা। গবেষণায় বিশ্বের স্তন্যপায়ী প্রাণীজগতে অজ্ঞাত জুনোটিক ভাইরাস প্রজাতির সংখ্যা হিসাব করে দেখা হয়েছে। আরও দেখা গেছে যে জুনোটিক ভাইরাস বাহিত হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি রয়েছে বাদুর থেকে। অন্য যে কোন স্তন্যপায়ী প্রজাতির তুলনায় বাঁদুরের প্রতিটি প্রজাতির অনেক বেশি জুনোটিক ভাইরাস বহন করে। যেসব জায়গা অজ্ঞাত জুনোটিক বাদুরবাহিত ভাইরাস দেখা দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো হলো আমাজান ও ওরিনোকোর ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল এবং দক্ষিণ আমেরিকার ক্যারিবীয় উপকূল। আফ্রিকার পূর্ব ও মধ্যঞ্চলে খুরওলা প্রাণীরা জুনোটিক ভাইরাস বহনের জন্য অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ। মহাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের মাংসাশী প্রাণীগুলোও একই ধরনের ঝুঁকিবহুল। বানর, শিম্পাঞ্জী, গবিলা প্রভৃতি প্রাইমেটরা দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিষুবীয় অঞ্চলগুলোতে জুনোটিক ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ী হতে পারে। প্রতিবছর বিশ্বে লাখ লাখ লোকের অসুস্থতা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুর জন্য দায়ী জুনোটিক ভাইরাস যা আসে পশুর শরীর থেকে। জেনে রাখা প্রয়োজন যে পশু পাখিরা জুনোটিক ভাইরাস বহন করলেই যে তারা অসুস্থ হয়ে পড়বে এমন কোন কথা নেই। অনেক প্রাণী শরীরে জুনোটিক ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছে এবং তারপরও দিব্যি সুস্থ আছে। অথচ সেই ভাইরাসের সংস্পর্শে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। জানা গেছে যে মানুষের ক্ষেত্রে প্রতি ১০টি জ্ঞাত সংক্রামক রোগের মধ্যে ৬টিরও বেশি এবং প্রতি ৪টি নতুন সংক্রামক রোগের মধ্যে ৩টি পশুর দেহ থেকে ছড়ায়। অনেক মানুষই তাদের দৈনন্দিন জীবন পশু পাখির সংস্পর্শে আসে। সেটা বাড়িতেও হতে পারে, বাড়ির বাইরেও হতে পারে। পোষা প্রাণী মানুষকে সঙ্গ দেয়, আনন্দ দেয় এবং উভয়ের অজান্তে ভাইরাসও ছড়িয়ে দেয়। আমেরিকায় তো লাখ লাখ বাড়িতে এক বা একাধিক পোষা প্রাণী থাকে। এই মানুষগুলোর জানার কথা নয়। তাদের এই পোষা প্রাণীগুলো কোন জুনোটিক ভাইরাস বহন করছে কিনা। করে থাকলে এসব প্রাণীর মুখের লালা, রক্ত, প্রস্রাব, নাসিকা থেকে নির্গত লালা ও শরীরের অন্য কোন জলীয় অংশের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এলে ঐ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব প্রাণীর দাঁতের মৃদু কামড় বা নখের আঁচড় থেকেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। প্রাণীরা ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন অবস্থা থেকেও পরোক্ষ সংস্পর্শ ঘটতে পারে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×