ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সমন্বিত উন্নয়নের রূপকার

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১১ জুলাই ২০১৭

সমন্বিত উন্নয়নের রূপকার

প্রধানমন্ত্রী গত ০২.০৭.১৭ ইং সচিবদের সঙ্গে প্রায় চারঘণ্টা সভা করে যে ১৭টি নির্দেশনা দিয়েছেন তা এক কথায় বলতে গেলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী সমন্বিত উন্নয়নের ভিশন। একজন অর্থনীতিবিদ কিংবা একজন সমাজ বিজ্ঞানী যুগপৎভাবে উন্নয়নের যে তত্ত্ব দাঁড় করান তার মূল কথা হলো একটি উন্নয়নের দুটো দিক সমান গতিতে চলতে হবে তবেই সেটি হবে একটি সুষম ও সমন্বিত উন্নয়ন। একসময় অর্থনীতিবিদরা ভাবতেন কোনও দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় কিংবা কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হলেই কেবল উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা, উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানো ও জনগণের আত্মপোলব্ধির ক্ষেত্রে যদি ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত না হয় তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল ধরে রাখা সম্ভব নয়। সে কারণে টেকসই উন্নয়ন মানেই সমন্বিত উন্নয়ন। শেখ হাসিনা প্রায় সময়ই জনসভায় বলে থাকেন ‘আওয়ামী লীগ যখন সরকারে আসে তখন জনগণ কিছু পায়। জনগণের উন্নয়নই জাতীর পিতার স্বপ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়তে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে আমরা আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর।’ সত্যি সোনার বাংলা কোন অলৌকিক স্বপ্ন নয়। বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের হাত থেকে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বপ্ন পূরণে রাজনীতি করতেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থন করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার হয়েছিলেন। এবং মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নিতে চাননি। অসহায় দরিদ্র বঞ্চিত মানুষের জন্যই যেন তার রাজনীতি। যে রাজনীতিবিদ সারাজীবন সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাজ করেছেন তারই উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা তো সেটাই করবেন। এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে যে ‘ভিশন ২০১০- ২০২১’ আওেয়ামী লীগ সরকার ঘোষণা করেছে তা পূরণ করা কঠিন নয়। কারণ শেখ হাসিনা উন্নয়নের আধুনিক তত্ত্বটি ভাল করেই রপ্ত করতে পেরেছেন। তিনি দেখেছেন একজন কৃষক যদি সুষম খাবারের অভাব পূরণ করতে পারে তাহলে তার সামাজিক মান বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতির সুপার কাঠামো বা উপরি কাঠামোর সুবিধাগুলো ভোগ করা তার জন্য কঠিন হবে না। সে কারণে কৃষিতে ব্যাপক ভর্তুকি, কৃষি ঋণ সহজীকরণ, সার বীজ, কীটনাশক সহজলভ্য করণ ও আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে কৃষককে পরিচিতি করে তোলার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। কৃষি গবেষণায় ব্যাপক সাফল্যের কারণে আজ আবাদী জমি হ্রাস পাওয়ার পরেও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৯৭১ সালে জনসংখ্যার জন্য যে টুকু আবাদী জমি ছিল তা আজ প্রায় অর্ধেকের কোঠায় অথচ জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও অধিক (সাড়ে সাত কোটি থেকে প্রায় সতেরো কোটি)। তারপরও মানুষের মুখে হাসি, মাথাপিছু আয় বারো হাজার মার্কিন ডলার, ঘরে ঘরে শিক্ষা স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল গ্রামের কৃষক থেকে সকলেই পাচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদে মিলছে যাবতীয় তথ্য, ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস, স্বাস্থ্য সেবা মিলছে মোবাইল ফোনে। পরীক্ষার ফলাফল নিমিষেই দেখা যাচ্ছে নেটের বদৌলতে। স্কাইপিতে মা তার সন্তানকে দেখছে মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে। টাকা আসছে মোবাইল ফোনে। ঘরে বসে ট্রেনের বাসের টিকিট মিলছে কয়েক সেকেন্ডে। কি হচ্ছে না গ্রামের উত্তরপাড়া থেকে দক্ষিণ পাড়া কিংবা পূর্ব পশ্চিমে? সবই সম্ভব হচ্ছে শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশে। শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষা মানুষের একদিকে যেমন সচেতনতা বৃদ্ধি করে অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম করে। দেশে প্রায় ৬৩ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি প্রায় ৯৭.৯৪%। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে প্রায় ৩৪ কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষার অগ্রাধিকার শেখ হাসিনার লক্ষ্য। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে একজন শিক্ষার্থী যেন একটি সার্টিফিকেট নিয়ে কাজের সুযোগ পায় তার জন্য (পিএসসি) এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই কোন শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে ঝড়ে পড়লে সে যেন একটি সার্টিফিকেট পায় তার জন্য জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন শিক্ষিত যুবক কখনও বেকার থাকে না। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী কারিগরি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বারোপ করেছেন। কর্মমুখী শিক্ষার মূল কথাই হলো আত্মকর্মসংস্থান। সরকারের কাছে কাজ চাওয়ার প্রয়োজন হয় না এ শিক্ষায়। নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে অথোর্পাজনের সুযোগ সৃষ্টি করাই কর্মমুখী শিক্ষার লক্ষ্য। ‘শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ এই হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সেøাগান। এই সেøাগানকে সামনে রেখে দেশে বর্তমানে প্রায় ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, ৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ ১১৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধমে বছরে ৯৯,১০৮ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস করার লক্ষ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৭শ’ কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করেছেন। ১৩৬টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করায়, শিশু মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হওয়ায় জাতিসংঘ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুরস্কৃত করেছেন। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য ২০১১ সালে ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজটিাল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক ‘সাউথ সাউথ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও ২০১১ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ও ২০১২ সালে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাত্রা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রূপকল্প ২০১০-২০২১’এ প্রকাশ পেয়েছে। রূপকল্প বাস্তবায়নে দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) সফলভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে সরকার সফল হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য কাজ করছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিগত বছরগুলোতে ৬.০০% স্থির ছিল, সম্প্রতি তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৫% এ ৭.০০% উন্নীত করতে কাজ করছে। জনগণের মাথাপিছু আয় ৬১৯ থেকে ১৩১৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক রফতানি । এ খাতে সরকার ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২৫ বিলিয়িন মার্কিন ডলারে রফতানি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। ১০ মিলিয়ন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। বিদ্যুত ব্যবহার ৪৫% থেকে এখন প্রায় ৭৪% এ উন্নীত হয়েছে। গ্রামের সাধারণ জনগণের জন্য শেখ হাসিনার সরকার ১৪০টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রায় ২৫% পরিবারকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম টার্গেট হিসেবে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ ‘ঘরে ফেরা’ ‘আশ্রয়ণ’ ‘সবার জন্য খাদ্য’ প্রভৃতি প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি ১০ লাখ কৃষক, এক লাখ ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এবং দুই লাখ ৬০ হাজার দরিদ্র মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ পেয়েছে। বেকারত্ব দূর করতে সরকার ১২.৯ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছেন এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি মধ্যম আয়ের দেশ। আগামী ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ। সমন্বিত (অর্থনৈতিক ও সামাজিক) উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রভূত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের ধারাবাহিকতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি সরকার পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হলে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে করতেই সময় চলে যায় ফলে পরবর্তী সরকার আর পূর্বের সরকারের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে চায় না। এতে সরকারের অর্থের যেমন অপচয় হয় উন্নয়নও ব্যাহত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বর্তমান সরকার আবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যেমন গতি পাবে, তেমনি জনগণ পাবে একটি সুখী সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ। লেখক : কলেজ শিক্ষক [email protected]
×