ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১১ জুলাই ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

চলতি সপ্তাহেও ঢাকার দিনরাত আলোচনা চলছে একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে। না বলে দিলেও পাঠকরা ঠিকই অনুমান করতে পারছেন কোন্ দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। ঠিক ধরেছেন, সর্বত্র এখন আলোচনার শীর্ষে নতুন বিপদ চিকুনগুনিয়া। একটি জরিপ বলছে, ঢাকায় প্রতি ১১ জনের একজন এই মহাযন্ত্রণাময় রোগের শিকার। তাই এটিকে ‘মহামারীতুল্য’ বললে অত্যুক্তি হবে না। সামান্য ক্ষুদ্র এক মশা দশাসই মানুষকে রীতিমতো কাবু করে ফেলছে। জ্বর না হয় দু-দশ দিনে সেরে যাচ্ছে কিন্তু সারাশরীরে তীব্র ব্যথা থেকে মুক্তি মিলছে না এক দেড় মাসেও। ইতোমধ্যে ঢাকার বাইরের মানুষ এই রোগের নাম দিয়েছে হাড়ভাঙ্গা রোগ। হাড় না ভাঙ্গলেও আহত অস্থি-র মতোই দশা হয় মানুষের, শরীর বেঁকে যায়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। ঢাকায় ডেঙ্গু প্রথম প্রথম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল নগরবাসীর মনে। তবে ঘাতক ওই রোগটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েনি চিকুনগুনিয়ার মতো। পরিষ্কার পানিতে বংশ বিস্তারকারী এডিস মশার কামড়েই হচ্ছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। তাই এই মশাকে ঘায়েল করার জন্যও চাই নতুন ধরনের কৌশল। মশা মারার দায়িত্ব আসলে কার? ঢাকার মশা নিধনের দায়িত্ব মশক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। কিন্তু এই দফতরের ব্যর্থতার পর এ কাজ এখন চলছে যৌথভাবে। অধিদফতরের মোট জনবলের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু জনবল যুক্ত করে যৌথভাবেই নগরীর মশা নিধনের কর্মসূচী পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। কোনভাবেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাজেটের দিকে নজর দিলে মনে হবে মশা মারার জন্য কামান দাগার প্রস্তুতি রয়েছে কর্তৃপক্ষের। গত ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মশা নিধন খাতে বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। চলতি বছর (২০১৬-২০১৭) তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। একই অর্থবছরে উত্তর সিটি কর্পোরেশন ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা থেকে বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। একদিকে বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে, অপরদিকে পাল্লা দিয়ে ভয়ঙ্কর মশাও বেড়ে চলেছে। তাই কাজে কোন গাফেলতি কিংবা দুর্নীতি হচ্ছে কিনা সেটি অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার। তবে প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহরের মশা মারার কাজ শুধু মেয়র কিংবা কোন সংস্থার ওপরে চাপিয়ে দিয়ে নিজে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সচেতন মানুষ এখন নিয়মিতভাবে নিজ ঘরের মশা মারছেন, এসি-ফ্রিজের জমে থাকা পরিষ্কার পানি ফেলে দিচ্ছেন। দিনের বেলায় যেহেতু এডিস মশা বেশি কামড়ায়, তাই অনেকে সে সময়ে মশাকে দূরে রাখার জন্য বা তার কামড় থেকে বাঁচতে বিশেষ ক্রিম মাখছেন। এ জাতীয় ক্রিম প্রতিবেশী দেশ থেকেই আসছে। আমাদের দেশে কেন এই ক্রিম তৈরি হয়নি সেটি অনেকের কাছেই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরনো সেই আষাঢ়ের গল্প আষাঢ়ে গল্প বলে একটি প্রবচন চালু আছে যার সরল অর্থ হলো বানোয়াট কথা। সোজা বাংলায় গালগল্প, যা বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এমন দিনে তারে বলা যায়। বর্ষার দিনে মন উজাড় করে কথা বলতে ইচ্ছে হয়, সময়-সুযোগ থাকলে তা বলেও থাকে মানুষ। আষাঢ় মাসে ঝুম বৃষ্টির ভেতর আড্ডা জমে উঠতে পারে, কিংবা দু’জনের ভেতর একান্ত কথোপকথন। সেসব আষাঢ় মাসের গল্প হলেও তাকে আষাঢ়ে গল্প বলা যাবে না। ঢাকার নিজস্ব আষাঢ়ের গল্প আছে, যা প্রতি বছরই পুরনো রেকর্ড বাজায়। আষাঢ় অবশ্য বিদায় নিতে চলল, কিন্তু ঢাকার এই গল্প শ্রাবণ-ভাদ্র পেরিয়ে আরও কত দূর বিস্তৃত হয় সেটাই দেখার বিষয়। বর্ষার সঙ্গে ঢাকাবাসীর দুর্ভোগের শুরু হয়। সেটি হলো জলাবদ্ধতা। ঢাকা শহরে মাত্র দুই ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টি হলে বহু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়া নতুন কিছু নয়। জলাবদ্ধতা মানেই চলাচলে মন্থরগতি চলে আসা। প্রধান প্রধান সড়ক বৃষ্টিতে তলিয়ে না গেলেও দু’পাশে অনেকটা পানি জমে যায়, ফলে চলাচলের জন্য সড়কও সঙ্কুচিত হয়ে আসে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই ঢাকায় যানজট লেগে থাকে। তার ওপর জলজট হলে সেই যানজট কতখানি অসহনীয় হয়ে ওঠে তা ঢাকাবাসী মাত্রই জানেন। সংবাদপত্রের পাতায় আবার জায়গা করে নেয় সড়কের খানাখন্দে পড়ে রিক্সা উল্টে বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে নাস্তানাবুদ হওয়া পথচারীদের ছবি। এসব দেখে কষ্টের পাশাপাশি ক্ষোভের উদ্রেক হয়। একই কথা বার বার বলতে কারই বা ভাল লাগে! তবু বলতেই হচ্ছে। এই অবস্থার অবসান হবে কবে? গত সপ্তাহে এক দু’দিনের বৃষ্টি আমাদের ইঙ্গিত দিয়েছে আগামী দিনগুলোতে কী হবে ঢাকার পানি নিষ্কাশন ও যাতায়াতের অবস্থা। একটি আধুনিক নগরীতে জলাবদ্ধতার কোন সুযোগ নেই। ঢাকা মহানগর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠায় এবং মরণাপন্ন দশায় উপনীত হওয়ার পরও সাবধানতা অবলম্বন করে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় এশহর এখন জলাবদ্ধতার শিকার। শুধু জলাবদ্ধতা না বলে এটাকে মহাজলাবদ্ধতা বললেই বোধকরি সঠিক হবে। অন্তত এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর ঢাকায় নতুন নতুন এলাকায় জলজট দেখা দেয়ায় একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। একদিকে ঢাকার জলাশয় ও খালগুলোকে ভরাট করে বহুতল ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে মহানগরীর চারপাশের নদীগুলোকে দখল-দূষণের মাধ্যমে অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। তাই স্বাভাবিক বৃষ্টিতে জল ধরে রাখা, জলের প্রবাহ এবং সর্বোপরি জলের গন্তব্যÑ সব এলোমেলো করে ফেলা হয়েছে। এক মহাবিপর্যস্ত পরিস্থিতি। ফলে কোন টেকনিকই আর কাজে আসছে না। এর ওপর রয়েছে অতিরিক্ত জনচাপ এবং যানের আধিক্য। বাধ্য হয়েই সতর্কতামূলক অনেক কথাই ভাবতে হয়Ñ ঢাকাকে বলছি বটে রাজধানী, কিন্তু একে কি রাজধানী বলে? ঢাকা দেশের প্রধান শহর, প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র, দেড়-দু’কোটি মানুষের আবাস, কূটনীতিকদের বিচরণক্ষেত্র, সারাদেশের যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র। এ রকম একটি শহরে অসহনীয় নাগরিক ভোগান্তি থাকা অত্যন্ত অসমীচীন। ঢাকাকে আধুনিক গতিশীল মসৃণ জীবনের নগর হিসেবে গড়ে তোলার জোরদার প্রচেষ্টা গত দুই দশকে কি আমরা দেখেছি? অথচ এ সময়ে ঢাকা উপচে পড়ে মানুষে, ভবনে, বিচিত্র প্রতিষ্ঠানে। ঢাকার দুই মেয়রের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বর্ষায় মানুষের ভোগান্তি কমাতে উদ্যোগ নিন। আগামী বর্ষায় ঢাকার খানাখন্দে পড়ে কেউ আহত হবে না, এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলুন। জলাবদ্ধতাকে কেউ যেন অভিশাপ হিসেবে দেখতে শুরু না করেÑ তার ব্যবস্থা নিন। দেয়াল থেকে কাগজে ও ফেসবুক ওয়ালে পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে একসময় ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে অভিনব এক বাণী লেখা থাকতোÑ ‘কষ্টে আছে আয়জুদ্দিন’। কী তার কষ্ট খোলাসা করা হয়নি। হয়তো তার কষ্টের অবসান হয়েছে। এখন আর সেই আয়জুদ্দিনের হদিস নেই শহরে। তবে গত কয়েক মাস ধরে ঢাকার বেশ কয়েকটি সড়কের দেয়ালে একই সিরিজের কয়েকটি দেয়ালচিত্র (সচিত্র দেয়াল লিখনও বলা যায়) দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সেসব ছবি আবার জায়গা করে নিচ্ছে খবরের কাগজে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ওয়ালে। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা তোর ভাগ্যে কিছু নেই’ কিংবা ‘সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে’ -এই কথাগুলো এখন লেখা দেখা যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের দেয়ালে। কে এই সুবোধ? কেন তাকে পালিয়ে যেতে বলা হচ্ছে? এই শহর থেকে নাকি সময় থেকে তাকে পালাতে বলা হচ্ছে? কিংবা কারাই বা এসব বলছে সুবোধকে? এসব কোন প্রশ্নেরই অবশ্য উত্তর মেলেনি এখনও। সুবোধের এই দেয়ালচিত্রগুলোর একটি আঁকা হয়েছে আগারগাঁও থেকে শিশুমেলার দিকে যেতে বাম দিকের একটা দেয়ালে। সেখানে সুবোধ বাক্সবন্দী একটা হলুদ সূর্য হাতে নিয়ে এক পাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে লেখা, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।’ রোকেয়া সরণিতে আবহাওয়া অফিসের বিপরীত পাশে পুরনো বিমানবন্দর দেয়ালে একই ভঙ্গিতে দাঁড়ানো সুবোধ। তবে সেখানে বাক্সবন্দী সূর্যটার রং লাল। পাশে লেখা, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই।’ আর আগারগাঁও-মহাখালী লিংক রোডে পুরনো বিমানবন্দরের দেয়ালে এক সারিতে আঁকা হয়েছে সুবোধের তিনটি গ্রাফিতি। তার একটিতে সুবোধ হতাশায় নতমুখ, একটিতে পালানোর ভঙ্গিতে, আরেকটিতে কেবল বাক্সবন্দী সূর্যটা দড়িতে ঝোলানো। রাজধানীর দেয়ালচিত্রের শিল্পীর পরিচয় এখনও জানা যায়নি। এই ঘটনা থেকে অনেকেরই মনে পড়ে যেতে পারে ইংল্যান্ডের দেয়ালচিত্রশিল্পী বাঙ্কসির কথা। দি নিউ ইয়র্কার-এ প্রকাশিত লরেন কলিনসের রচনায় উঠে এসেছে এই শিল্পীর প্রসঙ্গ। ‘তিনি এত সব করেও নিজেকে সবার চোখের আড়ালে রেখেছেন। আমার মনে হয় এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার। এ যুগে সবাই বিখ্যাত হতে চান অথচ তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করেননি।’ কথাগুলো বলেছেন হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা ব্রাড পিট। এই বাঙ্কসিকে, তিনি কী করেন? এক কথায় তিনি রাজনীতি সচেতন একজন ব্রিটিশ গ্রাফিতি আঁকিয়ে। দুনিয়ার অনেক দেশেই দেখা যায় তার গ্রাফিতি। বাঙ্কসির গ্রাফিতি সমাজ-রাজনীতির অনেক প্রশ্নকে মানুষের সামনে হাজির করে, মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে। তবে বাঙ্কসি নিজেই এক প্রশ্ন হয়ে রয়ে গেছেন আজ অবধি। কেউই জানেন না তার পরিচয়! ১৯৯৩ সালে ব্রিস্টলের ট্রেন ও দেয়ালে তার গ্রাফিতির আবির্ভাব ঘটে, ২০০১ সালে স্প্রে রঙে যুক্তরাজ্যজুড়ে তার স্বাক্ষর দেখা যায়। নিজেকে তিনি ‘উপদ্রবকারী’ হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করেন। পরিচয় গোপন রাখা যে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার একটি কৌশল, সেটা কিন্তু বাঙ্কসির ক্ষেত্রে খুবই সত্য। বহু বছর ধরে তিনি সামনাসামনি সাক্ষাতকার দিতে আপত্তি জানাচ্ছেন। বাঙ্কসির সবচেয়ে বিখ্যাত স্ট্রিট পেইন্টিং হচ্ছে সাদা ও কালো ইঁদুর নিয়ে করা স্টেনসিল। ছবিগুলো জীবন্ত ইঁদুরের আকারের। প্রতিটি ছবিতে রয়েছে কিছু দুষ্টুমি, যা ছবিগুলোকে লন্ডনের পথচারীদের কাছে খুব জনপ্রিয় করে তোলে। স্মিথফিল্ড মার্কেটের কাছে বাঙ্কসি এঁকেছিলেন ‘গ্যাংস্টার র‌্যাট,’ এই ইঁদুরের গলায় ছিল শান্তির চিহ্নযুক্ত মেডাল আর সে একটা ব্যানার বহন করছিল যাতে লেখা ‘ওয়েলকাম টু হেল’। আরেকটায় লেখা ছিল, ‘প্লিজ লাভ মি’। ঢাকার দেয়ালচিত্রের সুবোধকেও ভালোবাসার কাঙাল মনে হচ্ছে। সে বলছেÑ ‘মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’। ০৯ জুলাই ২০১৭ [email protected]
×