ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আজ

পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ বাল্যবিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১১ জুলাই ২০১৭

পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ বাল্যবিয়ে

নিখিল মানকিন ॥ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর ড্রপআউটের উচ্চ হার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে ড্রপআউটের হার এখনও ৩০ শতাংশ। ব্যবহারকারীদের এই অংশ পদ্ধতি গ্রহণ ও ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে খুবই উদাসীন। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের এখন যথেষ্ঠ জ্ঞান রয়েছে। বর্তমানে প্রজননক্ষম সকল দম্পতি পরিবার পরিকল্পনার কোন না কোন পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। কিন্তু অসচেতনতার অভাবে অনেক দম্পতির বেশি সংখ্যক সন্তান নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। কিশোরী অবস্থায় সন্তান ধারণের জন্য দারিদ্র্য ও অশিক্ষাও এর পেছনে ভূমিকা রাখছে। তবে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার গত ৪১ বছরে ৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন দাবি করেছে সরকার। ১৯৭৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর পদ্ধতি ব্যবহারকারী গড়ে মাত্র ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অপূর্ণ চাহিদা হ্রাস পেয়ে ১৪ থেকে ১৩.৫ এসেছে। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আজ মঙ্গলবার ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এর উদ্বোধনী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিসংখ্যানে পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার বৃদ্ধির চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬৫০ সালে ১ কোটি ছিল। তা ২শ’ বছর পর ১৯৫১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ২ কোটি ৩ লাখ হয়। এই জনসংখ্যা ৪ কোটি ২০ লাখ হয় ৯০ বছরে (১৯৪১ সালে ) । দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৯৭৯ জন মানুষ। বর্তমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল উর্ধগামী। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করলেও তা প্রত্যাশিত হারে নামেনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাল্যবিবাহ। এটি এখনও একটি বড় সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। ১৮ বছর বয়স হওয়ার পূর্বে মেয়েদের বিয়ে না দেয়ার বিদ্যমান আইন বেশি মাত্রায় লঙ্ঘন করা হয়ে থাকে। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই দেশে শতকরা ৬৬ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় । এর এক-তৃতীয়াংশ ১৯ বছর বয়স হওয়ার আগেই গর্ভবতী অথবা মা হয়ে যান। দেশে প্রতি হাজার শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ২ দশমিক ৯ জন মা মারা যান। তাদের মধ্যে কিশোরী বয়সে হওয়া মায়ের সংখ্যাই বেশি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর জানায়, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সফল করে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। আরও জোরালো করতে হবে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিক হার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচী বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রতি বছর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ শতকরা গড়ে ১ দশমিক ৫ ভাগ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১২ বছরে আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৪৭.৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬২.৪ শতাংশে উন্নীত হলেও স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিতে তেমন কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। প্রজনন হার বা মহিলা প্রতি গড় সন্তান জন্মদানের হার কমে বর্তমানে ২ দশমিক ৩ ভাগে নেমেছে। অপূর্ণ চাহিদার ক্ষেত্রে একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত মহিলাদের মধ্যেই অপূর্ণ চাহিদার হার সবচেয়ে বেশি। এ হার ১৯.৮ শতাংশ। এ বয়সীদের মধ্যে মাত্র ৩৭.৬ শতাংশ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়। আর বিবাহিতদের মধ্যে কিশোরী অবস্থাতেই গর্ভধারণ করেন শতকরা ৬৪ দশমিক ৩ ভাগ। এই হিসেবে দেশের ১৬ মিলিয়ন কিশোরী প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয়। শহরের তুলনায় প্রামে কিশোরী অবস্থায় মা হওয়ার প্রবণতা বেশি। রাজশাহী বিভাগে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি শতকরা ৩২ দশমিক ৮ ভাগ এবং সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৯ দশমিক ৭ ভাগ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১৬ মিলিয়ন কিশোরী প্রতিবছর সন্তান জন্ম দেয়, যাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরই ইতোমধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণের হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। শতকরা ৫ দশমিক ৭ ভাগ স্থায়ী এবং ৮ দশমিক ৬ ভাগ দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের পদ্ধতি গ্রহণের হার এখনও অনেক কম। শতকরা ৫ দশমিক ২ ভাগ পুরুষ স্থায়ী এবং অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, নারী ও শিশু সবার আগে, বিপদে-দুর্যোগে তারা প্রাধান্য পাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সহিংসতার কারণে ঘর-বাড়িহীন জীবন কাটাচ্ছেন বিশ্বের প্রায় ৫ কোটি মানুষ। এদের ৩ চতুর্থাংশই নারী ও কন্যা শিশু। সঙ্কটময় মুহূর্তের সম্মুখীন এসব নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, সহিংসতা জোরপূর্বক বিয়ে এবং যৌন রোগের ফলে মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে। কেননা তারা সেসময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুাবিধা পায় না। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর পরিকল্পিত পরিবার গঠনের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন, প্রজনন স্বাস্থ্য, নিরাপদ মাতৃত্ব, জেন্ডার বিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে বিগত ছয় দশক ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সকল সক্ষম দম্পতিদের যদি পরিবার পরিকল্পনা, মা-শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ও সেবা প্রাপ্তির সহজ সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তবে কর্মসূচীতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ অনেকাংশেই উত্তরণ করা সম্ভব। গর্ভকালীন সেবা, গর্ভবতীর বিপদচিহ্ন, নিরাপদ প্রসবে সম্ভাব্য বিলম্ব, প্রসব পরবর্তী পরিচর্যা ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক তথ্য সম্বলিত ওয়াল প্ল্যাকার্ড তৈরি করে তৃণমূল পর্যায়ের সেবাকেন্দ্রে প্রচার করা হয়ে থাকে। এমসিএইচ ইউনিট থেকে এ সকল সেবাকেন্দ্রে ইতোমধ্যে ডেলিভারি কিট সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় নব্বই শতাংশ শূন্যপদ পূরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি শূন্যপদ পূরণের জন্য জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। মহাপরিচালক আরও জানান, গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার ২০১১ সালের তুলনায় ৪৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ শতাংশ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও দক্ষ সেবাদানকর্মী দ্বারা প্রসবের হার বেড়ে প্রায় ৩৭ শতাংশ হয়েছে। শিশু মৃত্যু হ্রাসেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মে নবজাতকের মৃত্যুর হার ৩২ থেকে ২৮, এক বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু হার ৪৩ থেকে ৩৮ এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু হার ৫৩ থেকে ৪৬ এ হ্রাস পেয়েছে। অপূর্ণ চাহিদা হ্রাস পেয়ে ১৪ থেকে ১২তে এসেছে। আর ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে সন্তান গ্রহণ প্রবণতা অর্থাৎ কিশোরী বয়সে মাতৃত্বও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এসকল পরিমাপকে ধনাত্মক পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো সময়ের সঙ্গে মা ও শিশু স্বাস্থ্যে নতুন নতুন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। সরকারের এ প্রচেষ্টার পাশাপাশি গণমাধ্যমের সক্রিয় সহযোগিতা আমাদের একান্তভাবে কাম্য বলে জানান স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী। পরিচালক (এমসিএইচ-সার্ভিসেস) ডাঃ মোহাম্মদ শরীফ বলেন, দেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশই কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী। যার একটি বড় অংশ দ্রুত প্রজননক্ষম বয়সে প্রবেশ করছে। এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তাদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই খাতে যথাযথ বিনিয়োগের এখনই সময়। ২০১৫ সাল নাগাদ পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাল্যবিয়ে। এটি এখনও একটি বড় সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ করলে একজন কিশোরী মা তার জীবনী শক্তি হারায়। তার শিক্ষা জীবন সংক্ষিপ্ত হয়, শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অপরিপক্কতা দেখা দেয়। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকল্পে সচেতনতা কর্মসূচীর পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে। তরুণ প্রজন্মের প্রয়োজনীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে আগামীর উন্নয়ন নিশ্চিত হবে বলে জানান পরিচালক।
×