অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে চলতি বাজেটে যেসব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে তা এগিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। নির্বাচনী ডামাডোলে ভ্যাটের প্রস্তুতি যেন হারিয়ে না যায়। নতুন ভ্যাট আইনের পক্ষে থাকার কথা জানিয়ে বেসরকারী এই গবেষণা সংস্থা আরও বলেছে দু’বছর পর যখন আইনটি বাস্তবায়ন করা হবে-তখন সবকিছু যেন নতুন করে আবার শুরু করতে না হয়।
সোমবার সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। জাতীয় সংসদে সদ্য পাস হওয়ার পর বাজেট পর্যবেক্ষণ নিয়ে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, পরিচালক (সংলাপ) আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ। ওই সময় দেবপ্রিয় বলেন, নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করেছে। নতুন ভ্যাটের প্লেন উড়তে পারেনি, মুখ থুবড়ে পড়েছে। নির্বাচনের পরে যাতে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে না হয়, সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই অনলাইন-ব্যবস্থাসহ অন্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। ক্র্যাশ ল্যান্ড করা প্লেন আবার উড়াতে হবে-এখন এটাই মূল চেষ্টা হওয়া উচিত।
নতুন আইনের পক্ষে থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যদি ১২ শতাংশ একক ভ্যাট হার নিয়ে প্রস্তুতি নেয়া হতো, তবে নতুন আইনের এই পরিণতি হতো না। তিনটি কারণে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে মনে করে সিপিডি। এগুলো হলো প্রস্তুতির অসম্পূর্ণতা, রাজনৈতিক সহমতের অভাব এবং সামাজিক তাৎপর্যের প্রভাব। সিপিডি আরও বলেছে, একক ভ্যাট হার না থাকায় এত দিন যারা সুবিধা পেয়েছেন, নতুন আইনে তারা অসুবিধায় পড়তেন। আবার রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তি এত দিন অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিষয়টি দুই দিক থেকে দেখতে হবে।
এদিকে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কতটা অর্জিত হবে-এ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে সিপিডি। সিপিডি বলছে, রাজস্ব আদায়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একদিকে টাকা বিদেশে চলে যাবে, অন্যদিকে সৎ করদাতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে-এটা কোনভাবেই সমীচীন নয়। টাকা পাচারকারীর নাম-পরিচয় জানার পরও যদি কোন ব্যবস্থা নেয়া না হয়, আবার সৎ করদাতাদের ওপর করের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, এতে ন্যায়বিচার হয় না। সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এমনিতেই নির্বাচনের বছরে টাকা পাচার বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
এ ছাড়া চলতি বাজেটে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের মূলধন যোগানে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার সমালোচনা করেছে সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, এই টাকা দেয়া উচিত নয়। এটা সিন্ধুর মধ্যে বিন্দুর মতো তা তলিয়ে যাবে। তিনি বলেন, নতুন ব্যাংকের পাশাপাশি প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকও এখন সমস্যায় পড়েছে। ব্যাংকের অভ্যন্তরে সুশাসনের অভাব আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নজরদারি করার কথা ছিল, তা হয়নি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ আবর্জনা পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। এখনই সংস্কার-প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। সিপিডি মনে করে, বাজেটের ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে বেশি ঋণ নেয়ায় সরকারের দায় বাড়ছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এটি মধ্য মেয়াদে টেকসই হবে না। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে প্রণোদনা দিতে ১০ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই অর্থ ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা উচিত।
তিনি আরও বলেন, ট্যাক্সনেট বাড়াতে ট্যাক্সের সুবিধাগুলোর দেশের অন্যান্য বিভাগে সম্প্রসারণ করতে হবে। এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জনবল ও অবকাঠামো সুবিধা দিতে হবে। ফোর-জি লাইন্সেস সম্পর্কে তিনি বলেন, এই বছর ফোর-জি লাইন্সেস থেকে করবহির্ভূত অনেক আয় হবে। ফোর-জি বিক্রির ক্ষেত্রে বাধা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে লক্ষ্য রাখতে হবে। সম্প্রতি একটি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে, দুইটি একীভূত হয়েছে। প্রতিযোগিতা ও সর্বোচ্চ বিক্রি বাড়াতে বাইরে থেকে বিনিয়োগকারী নিয়ে আসতে হবে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সঞ্চারী হতে হবে। এ জন্য অর্থনীতি বহুমুখীকরণ করতে হবে। বেসরকারী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচী নিতে হবে। উৎপাদনশীলতা-নির্ভর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।