ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বই পাড়ার চৌহদ্দিতে -মাসরুফ হোসেন

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১০ জুলাই ২০১৭

বই পাড়ার চৌহদ্দিতে -মাসরুফ হোসেন

‘বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক’-কথাটি পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের। এই জ্ঞান আর আনন্দ ছাড়া মানব জীবন প্রায় হয়ে পড়ে নিশ্চল। জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত ও সুবাসিত করতে বই পড়ার বিকল্প নেই। দুঃখের বিষয়, ঢাকা শহরে বইয়ের দোকান হাতেগোনা ও নামমাত্র। ইতালির ছোট, অখ্যাত শহর কনেলিয়ানোর রেলস্টেশনেও বইয়ের দোকানে পাঁচ ভাষার বই পাওয়া যায়, আর মেগাসিটি ঢাকার সবচেয়ে বড় শপিংমলগুলোতে একটাও বইয়ের দোকান নেই। জাতি হিসেবে আমাদের মননশীলতার বর্তমান অবস্থা কি রকম তা এই ঘটনা থেকেই ধারণা করা যায়। মানুষ লাখ লাখ টাকার বাহারি বিভিন্ন জিনিস কেনে, কিন্তু বই কেনার বেলায় তাদের উপর ভর করে রাজ্যের উদাসীনতা। অথচ শপিংমলে হাতের কাছে বইয়ের দোকান থাকলে সেদিকেও যেতে পারে ক্রেতাদের নজর। বইপড়ুয়া অনেকেই জানতে চান বাংলাদেশে কোথায় বই পাওয়া যায়। জেনে নেয়া যাক, তেমনই কয়েকটি বই পাড়ার কথা। পাঠক সমাবেশ : ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের বিপরীতে জাতীয় জাদুঘর সংলগ্ন এই বইয়ের দোকানটি আন্তর্জাতিক মানের। এই দোকানে ঢুকলেই বইয়ের পাতার গন্ধে মন নেচে ওঠে। এখানে এলে আমি প্রথম পাঁচ মিনিট শুধু নিশ্বাস নিই! বুকওয়ার্ম : জাহাঙ্গীর গেট থেকে একটু এগিয়ে সাবেক সরকারী কর্ম কমিশনের পাশে এয়ারফোর্স রিক্রুটমেন্ট সেন্টার সংলগ্ন বইয়ের দোকান। ছোট, কিন্তু সুবিশাল সংগ্রহ। মুক্তিযোদ্ধা রফিক আঙ্কেল এখানে বসেন। আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন তিনি। ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত তাকভর্তি বই, পুরো নেশা জাগানিয়া! জিনাত বুক সাপ্লাই : নিউমার্কেটের ভেতরে বইপাড়ার এ দোকানটিই আমার সবচেয়ে প্রিয়। দারুণ সব দুষ্প্রাপ্য বই এখানে পাওয়া যায়। নিউমার্কেটের এই একটি বইয়ের দোকানের নাম বললেও পুরো বইপাড়াটিই ঘুরে দেখতে পারেন। বুক ভিউ, বুক ওয়েব, বুক পয়েন্ট এ রকম কিছু দোকানে বইয়ের সংগ্রহ চমৎকার। আজিজ সুপার মার্কেট : বাংলা বইয়ের সেরা সংগ্রহ এখানে পাবেন, সেই সঙ্গে ইংরেজী বইও। গোটাবিশেক বইয়ের দোকান আছে এ মার্কেটে। আগে আরও বেশি ছিল। বেইলি রোড : ভিকারুন্নিসা স্কুলের বিপরীতে সাগর পাবলিশার্স এবং আরও দুটো-একটি বইয়ের দোকান আছে এখানে। নীলক্ষেত : পুরনো বইয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা, নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। নীলক্ষেত সংলগ্ন ওভারব্রিজের সঙ্গে লাগোয়া মার্কেটের তিন তলায় ফ্রেন্ডস বুক কর্নার। ওখানে নতুন বইয়ের সুবিশাল সংগ্রহ। সস্তায় ক্লাসিকগুলোও পাওয়া যায় নীলক্ষেতে। কংকর্ড প্লাজা : ঢাকার কাঁটাবনের কাছে এই মার্কেটে বেশ কিছু দেশী প্রকাশনী রয়েছে। সেখানে ভাল বই পাওয়া যায়। বাংলাবাজার : বাংলাবাজারে সেবাসহ প্রায় সব বড় বড় প্রকাশনীর শোরুম আছে। বাংলাদেশে প্রকাশিত বইয়ের সবচেয়ে বড়, সস্তা, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং পুরনো সংগ্রহশালা এটি। পাঞ্জেরি বুক সাপ্লাই : শান্তিনগরে অবস্থিত পাঞ্জেরি বুক সাপ্লাই বা পিবিএস থেকে পুলিশ লাইব্রেরির জন্য অনেক বই কিনেছি। এর মালিক কামরুল হাসান শায়ক ভাই একজন বইপ্রেমী মানুষ। বই কেনার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেয়ার মজাই আলাদা। বাংলা, ইংরেজী দুই ধরনের বই এখানে পাওয়া যায়। বই বিচিত্রা : ধানম-ি সাতাশ নম্বর রোডের মাঝামাঝি, মিনাবাজারের পাশে একটু হেঁটে গেলেই চোঁখে পড়বে দোকানটি। এখানকার সংগ্রহ বেশ ভাল, বিশেষ করে বাংলা বই। ইংরেজী বইও আছে, তবে বেশিরভাগই পাইরেটেড কপি। জ্ঞানকোষ : আলিয়ঁস ফ্রঁসেস, ধানম-ির পাশেই এই দোকান। এখানে রয়েছে বাংলা-ইংরেজী বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। খুবই ভাল বইয়ের দোকান, সব ধরনের বই পাওয়া যায় এখানে। পুরানা পল্টন : পুরানা পল্টনের ফুটপাতে দুর্লভ বইপত্র ও ম্যাগাজিন খুব সস্তায় পাওয়া যায়। বাতিঘর : দীপঙ্করদার এই দোকানটির মতো সমৃদ্ধ বইয়ের দোকান শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই খুব বেশি নেই। এটি আন্তর্জাতিক মানের বইয়ের দোকান। চট্টগ্রাম গেলে প্রেসক্লাব সংলগ্ন এ দোকানটিতে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাই সরকারী কাজ শেষ করার পর। নন্দন : চট্টগ্রামের চেরাগী বাজারের বইয়ের গলির শেষ মাথায় আছে নন্দন নামের চমৎকার বইয়ের দোকানটি। কার্টুনিস্ট রণবী এ দোকানটির উদ্বোধন করেছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এর একটি শাখা আছে। বাংলা বইয়ের খুব ভালো সংগ্রহ এখানে, মাঝে মাঝে দুষ্প্রাপ্য বইও পাওয়া যায়। নূপুর মার্কেট : চট্টগ্রামের নূপুর মার্কেটের অমর বইঘর আর নিউমার্কেট থেকে একটু এগিয়ে দোতলায় পুরনো বইয়ের দোকানগুলোকে বলা চলে সোনার খনি। বইপত্র : সিলেটের এ বইয়ের দোকানে প্রথম যাই কমান্ডোদের সঙ্গে কাউন্টার টেররিজম শর্ট কোর্সের উইকেন্ডে। আশাই করিনি সিলেটে এত দারুণ একটা বইয়ের দোকান থাকবে! রকমারি : বান্দরবানেও এদের মাধ্যমে বই পাই ঘরে বসেই। অনলাইনভিত্তিক বইয়ের এ দোকানটি নিয়মিত গ্রাহককে নতুন বইয়ের খবর জানিয়ে ইমেইলে দেয়। প্যাপিরাস পাব : পুরনো বইয়ের ফেসবুকভিত্তিক দোকান। দুষ্প্রাপ্য সব বই হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায় ওদের পেজে। গো বুকিশ : এটাও ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন বুক শপ। অর্ডার করলে যে কোন বই এনে দেবে। আমি ৪০ জঁষবং ড়ভ খড়াব বইটি এদের মাধ্যমে এনেছিলাম। স্টকে থাকলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি দেয় ওরা। বিদেশী বই কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা দাম ও চাহিদার অপ্রতুলতা। পাশের দেশ ভারতে প্রতিটা বিদেশী বইয়ের নিজস্ব ভার্সন বের হয়, কারণ সেখানে রয়েছে বিদেশী বইয়ের ব্যাপক চাহিদা। আমরাই বই পড়ি না, বই আনা আমাদের দেশে লাভজনক নয়। জ্ঞানের রাজ্যে আমাদের অবস্থান তাই ভিখিরির মতোই। এই অবস্থার পরির্বতন করতে হলে নিজেকে দিয়েই শুরু করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বই জ্ঞানের ধারক-দাম দিয়ে এর বিচার হয় না। বই যে পড়ে না, তার জীবন মাত্র একটা। যে মানুষ বই পড়ে, এক জীবনেই সে স্বাদ পায় সহস্র জীবনের। এই প্রবাদবাক্য মাথায় রেখে আসুন শুরু করি বই পড়া এবং কেনা! লেখক : অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
×