ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রামের প্রকৃত উন্নয়ন ব্যাহত

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১০ জুলাই ২০১৭

অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রামের প্রকৃত উন্নয়ন ব্যাহত

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ উন্নয়নের মহাসড়কে অগ্রযাত্রার স্টিয়ারিংয়ে চাপ পড়েছে। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নানা অপকর্মের কারণে প্রকৃত অর্থে নিয়মমাফিক চলা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সার্বিক কর্মকা- এখন যেন ব্যাক গিয়ারে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর চট্টগ্রামকে বিদেশীরা বিনিয়োগের জন্য বরাবরই টার্গেটে রাখে। বিদেশী একক ও জয়েন্ট ভেঞ্চারে বহু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এ নগরীতে। শুধু তাই নয়, এ নগরকে কেন্দ্র করে সন্নিহিত এলাকাগুলো বিদেশীদের আকর্ষণ। কিন্তু নগরায়নে রয়েছে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার বড় অভাব। ফলে বর্তমানে এ নগরীর যে হতশ্রী রূপ হয়েছে তাতে শুধু বিদেশীরা নয়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের সর্বপর্যায়েও অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে। পাহাড় নদী ও সমুদ্র নিয়ে শহর চট্টগ্রাম ভৌগোলিকভাবে এমন স্থানে অবস্থিত যে, এখানে অর্থনীতির মূল কর্মকা- সর্বাগ্রে হাতছানি দেয় উদ্যোক্তাদের। এর অন্যতম প্রধান কারণ দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর এই নগরেই এবং এটিই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা-ের সোপান। কিন্তু যখন দেখা যায়, নগরজুড়ে অবকাঠামোগত চেহারায় হতশ্রী, সড়কগুলোর বেহালদশা, যানজটে নাকাল, ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক চলাচলটুকুও প্রতিবন্ধকতার জালে আবদ্ধ তখন স্বাভাবিক উন্নয়নের গতি পিছু টান দিয়ে আছে। চট্টগ্রামের সৌন্দর্য বৃদ্ধির দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক)। আর অবকাঠামো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির দায়িত্ব চউকের (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)। এছাড়া ওয়াসাসহ আরও কিছু সরকারী সংস্থা রয়েছে, যা একটি নগরকে এ প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর কাজে নিয়োজিত থাকে। কিন্তু এসব সংস্থার যে সেøাগান তা যেন ধান বানতে শিবের গীত। গ্রিনসিটি করার সেøাগান চসিকের। আর উন্নয়নের মহাসোপানের সেøাগানটি চউকের। কিন্তু এর বাস্তবতায় এ দুই সংস্থার যে অবস্থা তা নিয়ে তাদের হা-পিত্যেসও লক্ষণীয় নয়। উল্টো নতুন নতুন স্বপ্ন দেখানোর কাজে তারা যেন ব্যক্ত। চট্টগ্রাম মহানগরীর এক-তৃতীয়াংশ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সিটি মেয়র ঘোষণা দিয়েছেন এর সমাধানে ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন এবং তা চাওয়া হয়েছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। চউকের বক্তব্যও একই সুরে। বর্ষা শেষ হলে এ নগরী সৌন্দর্যে নবরূপ নেবে। শুধু তাই নয়, কর্ণফুলীর ড্রেজিং কাজেও কাজ শুরু করবে বলে চউকের ঘোষণা রয়েছে। যদিও এ কাজ এককভাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। এমন পরিস্থিতিতে নগর পরিকল্পানাবিদসহ আগ্রহী মহলে প্রশ্ন উঠেছে, উন্নয়নের চেয়ে গড়ে তোলা পুরনো অবকাঠামোগত উন্নয়নই তো ধরে রাখা যাচ্ছে না। সরকার প্রতিবছর যে বরাদ্দ দেয় তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য বলে তাদের দাবি। কিন্তু সে সামান্যও তো দৃশ্যমান নয়। দিন দিন সমস্যা বেড়ে পাহাড়সম হচ্ছে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা ও যানজট প্রকট রূপ নিচ্ছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন যান চলাচলে ট্রাফিক ব্যবস্থা নাকাল। জনচলাচল, বসতি, যানবাহনের গতিপ্রকৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে বেহাল রূপ। বিপুল অর্থ ব্যয়ে এ পর্যন্ত যেসব ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে সেগুলোতে যানবাহনের তেমন চলাচল নেই। এর মূল কারণ এসব ফ্লাইওভার যেখানে প্রয়োজন সেখানে না হয়ে অপরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে পরিকল্পনাবিদদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান পূর্তমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই বলেছিলেন, এগুলো ফ্লাইওভার নয়, ওভার পাস। তিনি নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ ও দাবির প্রতিধ্বনিই করেন। নগর পরিকল্পনাবিদরা নিয়ত নানা অভিযোগ তুলে পত্র পত্রিকায় বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে চিল্লাপাল্লা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কার কথা কে শোনে। এবারের বর্ষা মৌসুমে দুর্যোগ নেমে এসেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় পরিস্থিতি নজিরবিহীন। চট্টগ্রাম চললে দেশ চলে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৮৫ শতাংশেরও বেশি পণ্যের আমদানি ও রফতানি কার্যক্রম চলে। একক বৃহৎ রাজস্ব যোগান দেয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এ হাউসে আহরিত রাজস্বের গতি নিয়েই প্রতি সপ্তাহে একনেক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু দুর্যোগসহ নানা কারণে চট্টগ্রাম থমকে যায় তখন বন্দরেও এর আঘাত আসে। অর্থাৎ চলে না। বন্দর না চললে কাস্টমসে রাজস্ব আয় ব্যাহত হয় ব্যাপকভাবে। প্রায় ৬০ লাখ জনঅধ্যুষিত এ চট্টগ্রাম। বর্তমান সরকার দেশে প্রথম টানেলটি এই শহরে প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে এবং কাজও শুরু হয়েছে। দুটি নতুন বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে এই শহর সংলগ্ন এলাকায়। সরকারী-বেসরকারী ইপিজেডের আধিত্য এ শহরেই বেশি। রফতানির অন্যতম বৃহৎ খাত গার্মেন্টস শিল্প এ শহরেই জন্ম নিয়ে পরবর্তীতে এর বিস্তৃতি ঘটেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তৈরি ও উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী এ শহর হয়েই বিদেশে রফতানি হয়। আর বিদেশ থেকে আমদানি পণ্যের বড় অংশটি এ শহর হয়ে ঘুরে যায় দেশের অন্যান্য স্থানে। ফলে এ শহরের যখন বেহালদশা নেমে আসে তখন তা পুরো দেশের চালচিত্রে ভিন্নরূপ নেয়। কর্ণফুলী নদী মরে যাচ্ছে। দূষণ আর দখলে একাকার। দখল উচ্ছেদে এবং দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই। বর্ষা মৌসুমে প্রকট জলাবদ্ধতার কারণে প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে নৌকা চলে। অনেককে জাল ফেলে মাছ শিকার করতেও দেখা যায়। কিন্তু এ দৃশ্য তো কাম্য হতে পারে না। নগর অভ্যন্তর দিয়ে সবকটি খাল আর খালের রূপে নেই। কর্ণফুলী নদীতে চর জেগে একাকার হয়ে আছে। নগরবাসীসহ উৎস্যুক সকলের কাছে একটিই প্রশ্নÑ হচ্ছেটা কী? সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো করছেটা কী? সেমিনার, সভা সমাবেশের কমতি নেই। যার যার কথা তারাই বলে যাচ্ছেন। কাজের কাজ লক্ষণীয় নয়। এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার সমন্বয় নেই। আগেও ছিল না, এখনও নেই। এ সমন্বয়হীনতা চট্টগ্রামের জন্য বয়ে আনে সকল দুর্যোগ ও নানা অসুবিধা সৃষ্টির মূল কারণ। বর্তমানে অবস্থা এমন যে, আকাশে মেঘ দেখলে মানুষের মাঝে ভীতি। কারণ জলজট পরিস্থিতি উঁচু এলাকাগুলোকেও গ্রাস করছে। অথৈই পানিতে ডুবে যাচ্ছে। ফলে মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে। এটা করা হবে, ওটা করা হবে শুধু আশার বাণী। অথচ, ন্যূনতম যা দরকার তা-ই করা হচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন যে, যা দরকার নেই তা করা হচ্ছে। আর যেটির মূল দরকার সে ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা নেই। এ পরিবেশ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামীতে চট্টগ্রাম তো রসাতলে যাবেই, এর পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-সহ চট্টগ্রামভিত্তিক অন্য খাতগুলোতেও বিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য। এখানে উল্লেখ্য, দেশের প্রধান পর্যটন শিল্পগুলো গড়ে উঠেছে বৃহত্তর চট্টগ্রামভিত্তিক। কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িকে ঘিরে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের যে আকর্ষণ তা পূরণে চট্টগ্রামই হচ্ছে একমাত্র রুট। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পরিবেশ অগ্রহণযোগ্য থাকলে এ খাতটি বিপর্যস্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ চট্টগ্রামই দেশের এক-দশমাংশ এলাকা পর্যটন শিল্পের গেটওয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় অতি বর্ষণে যে বিপর্যকর পরিস্থিতি নেমে এসেছে এবং এর সঙ্গে চট্টগ্রামও যুক্ত হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের পর্যটন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে। আকাশ পথ ব্যবহৃত হয় শুধু কক্সবাজার নিয়ে। তাও শতাংশের হারে একেবারেই কম। আর তিন পার্বত্যাঞ্চলে যাবার অন্যতম প্রধান গেটওয়ে এই চট্টগ্রাম। আর এ কারণে চট্টগ্রামের বর্তমান মেয়র সর্বশেষ বক্তব্যে জানিয়েছেন, দুর্যোগ পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার এগিয়ে আসছে না তা বলা যাবে না। কিন্তু যেভাবে আসা প্রয়োজন এবং এর বাস্তবায়নে কড়া নজরদারি নিশ্চিত করার বিষয়টি রয়েছে তাতে যেন এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব। ফলে প্রতিবছর জলাবদ্ধতা নিরসনে যে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে তাতে কোন সুফল আসছে না। বরঞ্চ দুর্ভোগ যেন বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্নাঞ্চল ও শহরতলীর মানুষগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার। এ ক্ষতি অবর্ণণীয়। যারা এর শিকার হচ্ছেন তাদের ক্ষোভ প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। যা পরোক্ষভাবে সরকারের প্রতিই নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে এ ব্যাপারে নানা বক্তব্য ও সুপারিশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কারও যেন ভ্রুক্ষেপ নেই। বিশেষ করে চট্টগ্রামের জলজট পরিস্থিতি সবচেয়ে মুখ্য আলোচনায় চলে এসেছে। চট্টগ্রামের একটিমাত্র বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ। সে বাণিজ্যিক এলাকাও পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র জিইসি মোড়। এ মোড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ও উচ্চমানের হোটেল, গেস্ট হাউসসহ নানা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং এ খবর প্রতিনিয়ত সংবাদ মাধ্যমে দেশী-বিদেশীরা দেখছেন তাতে তারা চট্টগ্রামকে নিয়ে পিছপা হতে বাধ্য হচ্ছেন।
×